সূরা বাকারাহ–১৮৩। সিয়াম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে, সওয়াবের আশায় রামাদানের সিয়াম পালন করে, তার বিগত সকল গুনাহ (সগীরা) মাফ করে দেওয়া হয়’। আমরা অনেকেই মনে করি, সিয়াম সাধনার ফলে গুনাহ মাফ হয় ঠিকই, কিন্তু শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য তা ভীষণ ক্ষতিকর। সারা মাস সিয়াম পালনের ফলে শরীর–স্বাস্থ্যের পুষ্টি সাধনে বাধাপ্রাপ্ত হয় ইত্যাদি। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের মাধ্যমে চিরশাশ্বত তথ্যের সত্যতা বেরিয়ে এসেছে যে, সিয়াম শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়; বরং অত্যন্ত উপকারী এবং স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক। সিয়াম নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পর্যায়ে গবেষণার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদঘাটন করেছেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ডাঃ হেপোক্রেটিস বহু শতাব্দী পূর্বে বলেছেন, ‘অসুস্থ দেহে যতই খাবার দিবে, ততই রোগ বাড়তে থাকবে’। সমস্ত দেহে সারা বছরে যে জৈব বিষ (toxin) জমা হয়, দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার ফলে সে জৈব বিষ দূরীভূত হয়। তাছাড়া মানুষের শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ–প্রত্যঙ্গের উপর সিয়াম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। নিম্নে চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে সিয়ামের গুরুত্ব আলোচনা করা হ’ল–
মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রঃ সিয়াম মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের উপর সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করে, তাকে উজ্জীবিত ও উর্বর করে। এর ফলে মানুষের ধ্যান–ধারণা, মন–মানসিকতা পরিচ্ছন্ন হয় এবং স্নায়ুবিক অবসাদ ও দুর্বলতা দূর করে, সুদীর্ঘ অনুচিন্তন ও ধারণ সম্ভব হয়। যার ফলে মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহের এক অতুলনীয় ভারসাম্য সৃষ্টি হয়, যা সুস্থ স্নায়ুবিক প্রক্রিয়ার পথ প্রদর্শন করে এবং সূক্ষ্ম অনুকোষগুলি জীবাণুমুক্ত ও সবল রাখে ।
পণ্ডিতগণ বলেছেন, ‘ক্ষুধার্ত উদর জ্ঞানের আধার’। সিয়াম সাধনায় মানুষের মানসিক ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে। মনঃসংযোগ ও যুক্তি প্রমাণে স্মরণশক্তি বৃদ্ধি পায়। আর স্নায়ুবিক প্রখরতার জন্য ভালোবাসা, আদর–স্নেহ, সহানুভূতি, অতীন্দ্রিয় এবং আধ্যাত্মিক শক্তির উন্মেষ ঘটে। তাছাড়া ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ও বোধশক্তির তীক্ষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। এ ব্যাপারে ডাঃ আলেঙ হেইগ বলেন, ‘সিয়াম হ’তে মানুষের মানসিক শক্তি ও বিশেষ বিশেষ অনুভূতিগুলি উপকৃত হয়। স্মরণশক্তি বাড়ে, মনঃসংযোগ ও শক্তি পরিবর্ধিত হয়’।
হৃদপিণ্ড ও ধমনীতন্ত্রঃ মানবদেহে অতিরিক্ত মেদ বা চর্বি জমে রক্তে কোলেস্টেরল বেশী থাকে। রক্তে স্বাভাবিক কোলেস্টেরলের পরিমাণ হ’ল ১২৫–২৫০ মিলিগ্রাম ১০০ মিলিলিটার সিরামে (প্লাজমা)। এর বেশী হ’লে হৃদপিণ্ড, ধমনীতন্ত্র ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ–প্রত্যঙ্গগুলি মারাত্মক রোগ–ব্যাধি সৃষ্টি করে এবং ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। যেমন– হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বহুমূত্র, পিত্ত থলিতে পাথর, বাত–ব্যথা প্রভৃতি মারাত্মক জটিল রোগ। কিন্তু নিয়মিত সিয়াম পালনের ফলে দেহে অতিরিক্ত মেদ জমতে পারে না এবং রক্তের কোলেস্টেরলের পরিমাণ স্থিতিশীল করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাছাড়া হৃদপিণ্ডের ধমনীসহ সকল প্রকার ধমনীতন্ত্রগুলিও স্বাভাবিক পরিষ্কার ও সক্রিয় রাখে।
লিভার ও কিডনীঃ যকৃত মানব দেহের বৃহত্তম গ্রন্থি। যকৃতের ডান অংশের নীচে পিত্তথলি থাকে। যকৃত কর্তৃক ক্ষারিত পিত্ত জীবদেহের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। যকৃতের কার্যক্ষমতা লোপ পেলে জন্ডিস, লিভার সিরোসিসসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হ’তে হয়। স্নেহ পদার্থ শোষণে পিত্ত লবণ অংশ নেয়। এ ছাড়াও ল্যাঙেটিভ কাজে অংশ নেয় এবং কোলেস্টেরল লেসিথিন ও পিত্তরঞ্জক দেহ হ’তে বর্জন করে। কিন্তু সিয়াম সাধনার ফলে এই কার্যক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পায় এবং সকল অঙ্গগুলি সক্রিয় হয়ে উঠে। অন্যথায় সিয়ামের অসীলায় যকৃত ৪ হ’তে ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত স্বস্তি গ্রহণ করে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে এ দাবী খুবই যুক্তিযুক্ত যে, যকৃতের এই অবসর গ্রহণের সময়কাল বছরে কমপক্ষে একমাস হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। কেননা যকৃতের দায়িত্বে খাবার হজম করা ব্যতীত আরো পনের প্রকার কাজের উপর প্রভাব বিস্তার করে। তাছাড়া যকৃত স্বীয় শক্তিকে রক্তের মধ্যে Globulin সৃষ্টিতে ব্যয় করতে সক্ষম হয়। অনুরূপ কিডনীও শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের নাম। কিডনীকে জীবনও বলা হয়। কিডনী দেহে ছাকনী হিসাবে কাজ করে। যাকে রেচনতন্ত্র বলা হয়। কিডনী প্রতি মিনিটে ১ হ’তে ৩ লিটার রক্ত সঞ্চালন করে। রক্তের অপদ্রব্য পৃথকীকরণের মাধ্যমে মূত্রথলিতে প্রেরণ করে। সিয়াম অবস্থায় কিডনী বিশ্রামে থাকে। কিন্তু তার রেচনক্রিয়া অব্যাহত রেখে প্রস্রাবের মাধ্যমে অতিরিক্ত বর্জ্য পদার্থ ত্যাগ করে। যার জন্য মানুষ সুস্থ থাকে এবং রক্ত পরিষ্কার ও বর্ধিত হয়।
পাকস্থলী ও অন্ত্রঃ যকৃত ও পাকস্থলীর অবস্থান পাশাপাশি। বিভিন্ন খারাপ খাদ্যের প্রভাব যকৃতের উপর পড়ে। পাকস্থলী স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটারাইজড মেশিন। যার ভিতরে অনায়াসে বিভিন্ন প্রকার খাবার হজম হয়। পাকস্থলীসহ অন্যান্য অঙ্গ সক্রিয়ভাবে ২৪ ঘণ্টা কর্তব্যরত থাকা ছাড়াও স্নায়ুচাপ ও খারাপ খাদ্যের প্রভাবে এতে এক প্রকার ক্ষয় সৃষ্টি হয়। আবার অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের ফলে পাকস্থলীর আয়তনও বৃদ্ধি পায়। আর এই আয়তন বর্ধিত হওয়াতে মানুষের শরীরের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং তা স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর।
কিন্তু দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনা পাকস্থলীকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। শরীরের অন্যান্য পেশীর মত পাকস্থলীকে খাদ্যমুক্ত বা বিশ্রামে রাখা প্রয়োজন। এতে করে ক্ষয়পূরণ ও পুনর্গঠন কাজে সাহায্য করে। তাছাড়া গ্যাষ্ট্রিক জুইস এনালাইসিস করে যে এসিড কার্ভ পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় যে, সিয়াম অবস্থায় পাকস্থলীর এসিড সবচেয়ে কম থাকে। আমরা ধারণা করি যে, সিয়ামের অবস্থায় অম্লতা বেড়ে যায়। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। প্রকৃত সত্য হ’ল, সিয়াম অবস্থায় অম্লতা বাড়ে না, বরং কমে যায় এবং পেপটিক আলসার নির্মূলে সাহায্য করে। এ ব্যাপারে ডাঃ মুহাম্মাদ গোলাম মুয়াজ্জাম দীর্ঘ গবেষণা করে (১৯৫৮–১৯৬৩ পর্যন্ত) বলেন, ‘শতকরা প্রায় ৮০ জন সিয়াম পালনকারীর পাকস্থলীতে অম্লরসের প্রভাব স্বাভাবিক। আমার প্রায় ৩৬% জনের অস্বাভাবিক এসিডিটি স্বাভাবিক হয়েছে। প্রায় ১২% সিয়ামকারীর এসিডিটি সামান্য বেড়েছে। তবে কারো ক্ষতির পর্যায়ে যায়নি। সুতরাং সিয়াম পালনকারীর পেপটিক আলসার হ’তে পারে এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও মিথ্যা।
অগ্নাশয় ও কোষ নিয়ন্ত্রণঃ অগ্নাশয় মানব দেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এর গ্রন্থিরসে ইনস্যুলিন নামক এক প্রকার হরমোন তৈরি হয়। এই ইনস্যুলিন রক্তের মাধ্যমে দেহের প্রত্যেক কোষে পৌঁছে এবং গ্লুকোজেন অণুকে দেহকোষে প্রবেশে সাহায্য করে। অন্যথায় ইনস্যুলিন তৈরি ব্যাহত হ’লে, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে ডায়াবেটিস রোগ হয় কিন্তু সিয়াম সাধনার ফলে পাকস্থলী বিশ্রামে থাকে হেতু সেখানে খাদ্যরস বা গ্লুকোজ তৈরি ব্যাহত হয়। পক্ষান্তরে ইনস্যুলিন তৈরি অব্যাহত থাকে। যার কারণে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হয় না এবং ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য মারাত্মক রোগব্যাধি হওয়ার সম্ভাবনা সিংহভাগ কমে যায়।
দেহের কোষের মধ্যে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে গেলে, শরীর নিস্তেজ হয়ে যায় এবং কোষগুলি পূর্বের চেয়ে অনেক সংকুচিত হয়। এছাড়া শরীরে বাড়তি মেদ (চর্বি) জমতে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং ক্যালরির অভাবে মেদ ক্ষয় হ’তে থাকে। যার জন্য স্থূলাকার কমে যায় এবং স্বাস্থ্য স্বাভাবিক সুঠাম হয়। শরীরের অধিক ভার কমানোর জন্য এটাও এক প্রকার ‘থেরাপিউটিক’ ব্যবস্থা। জ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে এ কথা সহজেই বলা যায় যে, লালা তৈরিকারী কোষগ্রন্থি, গর্দানের কোষগ্রন্থি এবং অগ্নাশয়ের কোষগ্রন্থিসমূহ অধীর আগ্রহের সাথে মাহে রমযানের অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ থাকে । আর এভাবেই সিয়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও স্থূলাকার ধীরে ধীরে কমতে থাকে। আবার ওযন কমেও মানুষ দুর্বলবোধ করে না। বরং স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সুস্থতাবোধ করে। সিয়াম মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়; বরং অত্যন্ত কার্যকরী ও উপকারী। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে তাঁর ইবাদত করার তাওফীক্ব দান করুন, আমীন!
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল