দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস করার পক্ষে তাদের মত ব্যক্ত করেছে। অন্যদিকে স্কুল খুলে দেওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন ৭৬ শতাংশ অভিভাবক। গণসাক্ষরতা অভিযান পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য উঠে এসেছে। দৈনিক আজাদীতে গত ২০ জানুয়ারি ‘দ্রুত ক্লাসে যেতে চায় ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী’ শীর্ষক প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বেসরকারি এ শিক্ষা জোট স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে ধাপে ধাপে স্কুলগুলো খুলে দেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত ঘোষণা দেওয়া প্রয়োজন বলে সুপারিশ দিয়েছে। গবেষণা ফলে জানানো হয়, ৭৩ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা স্কুল খুলে দেওয়ার পক্ষে মত দেন। ৮০ শতাংশ এনজিও কর্মকর্তা একই মতামত দিয়েছেন। ৫৮ শতাংশ শিক্ষক, ৫২ শতাংশ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সতর্কতার সঙ্গে স্কুল খুলে দেওয়ার পক্ষে মত দেন। ৮২ শতাংশ শিক্ষক স্কুল খুলে দেওয়ার আগে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক ব্যবহার, স্যানিটাইজার ও শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। আর ৭৯ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষক বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার আগে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টির ওপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করেছেন। ৯০ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অভ্যাস তৈরিতে অভিভাবকরা তাদের সচেতন করবেন।
এদিকে সংক্রমণ কমতে থাকায় শীত মৌসুম শেষে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগামী ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মচারীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশিকায় স্কুল-কলেজ খোলার আগে পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আকর্ষণীয় করাসহ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের শিফটিং করে নিরাপদ দূরত্বে ক্লাসে বসা, প্রথম ১৫ দিন সহ-শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করে আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি এবং দুই মাসের মধ্যে কোনো পরীক্ষা না নেওয়ার কথা বলা হয়েছে নির্দেশনায়।
বহু বছর ধরে বিশেষজ্ঞরা ডিজিটাল শিক্ষা বাস্তবায়নের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করে আসছিলেন। কিন্তু প্রক্রিয়াটি ছিল একই সঙ্গে ধীর এবং হতাশজনক। ফলে প্রথা ভেঙে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাপদ্ধতি গ্রহণ করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। কিন্তু বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির বিস্তার ওই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে। দেশের পর দেশ যখন করোনার মোকাবিলায় লকডাউনকেই একমাত্র পন্থা হিসেবে বেছে নিয়েছিল, তখন ইন্টারনেটভিত্তিক শিক্ষাই একমাত্র উপায় হিসেবেই পরিগণিত হয়েছে।
কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা নিয়ে নানা নাগরিক মতামত এখন উঠে এসেছে পত্র-পত্রিকায়। নাগরিকদের অনেকে বলছেন, বিয়েশাদিতে এখন ক্লাবগুলোতে উপচে পড়ছে মানুষ। মেজবান, হাট বাজার, হোটেল রেস্টুরেন্ট, পর্যটন স্পট, ট্রেন বাস বিমান লঞ্চ,সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যাংক, বিচারালয় সবকিছুই চলছে আগের মত। সবই চলছে যথারীতি, বন্ধ শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করছে, শিক্ষকরাও যথাসম্ভব চেষ্টা করে যাচ্ছেন, অনলাইনে শিক্ষা দিতে। যেখানে নাগরিক সুযোগ সুবিধা আছে, কম্পিউটার ল্যাপটপ, স্মার্ট ফোন আছে, ওয়াইফাই সুবিধা আছে, সাথে অভিভাবকদের আর্থিক সঙ্গতি আছে, তারা হয়তো আংশিকভাবে হলেও লেখাপড়ার ক্ষতিটা পুষিয়ে নিচ্ছেন। সরকারি ও এমপিও ভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সরকার থেকে যথারীতি বেতন ভাতাদি পাচ্ছেন। শহরে, যেসকল বেসরকারি নন এম পিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, তারাও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি আদায় করছে, শিক্ষকদের বেতনও তারা দিচ্ছেন, কারণ শিক্ষকরা অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। কিন্তু শহরে বা গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে যারা পড়ে, তাদের বেশিরভাগই বিত্তহীন, নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে। তারা অনলাইন ক্লাসের সুযোগটা নিতে পারছে না আর্থিক সঙ্গতির অভাবে। অনেক বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকেরা মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছেন না। অনেকে শিক্ষকতা না থাকায় অভাবে অনটনে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
তাঁদের প্রশ্ন হচ্ছে, করোনার তুঙ্গ সময়ে যদি সরকার সবকিছু খোলা রাখেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়ার কথা কেন বিবেচনায় আনছেন না? লেখাপড়ার যে ক্ষতিটা এতে হচ্ছে, তা কি পোষানো আদৌ সম্ভব হবে। যদি ভাবেন, শিক্ষার চেয়েও মানুষের জীবন বাঁচানো ফরজ, তাহলে সেটা কি শুধু দরিদ্রশ্রেণীর জন্য? বন্ধ যদি রাখতে হয়, সমন্বিত চিন্তায় সবকিছু বন্ধ রাখেন, শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে একটা বিশেষ শ্রেণীকে পঙ্গু বানিয়ে ফেলার কোনও অর্থ হয় না। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের সাম্প্রতিক ভাবনা যথেষ্ট গুরুত্ববহ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধাপে ধাপে পাঠকক্ষে শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনা জরুরি।