সহিংসতার পর রাঙামাটিতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। ওখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় গতকাল তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া পরিবহন ধর্মঘটও প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে অবরোধ চলছে। খাগড়াছড়িতে গতকাল অবরোধের দ্বিতীয় দিনও শান্তিপূর্ণভাবে অতিবাহিত হয়েছে।
রাঙামাটিতে স্বাভাবিক হচ্ছে পরিস্থিতি : রাঙামাটি প্রতিনিধি জানান, পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে শুক্রবার সহিংসতার ঘটনায় দুপুর ১টা থেকে পৌর এলাকায় জারি করা ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হয়েছে। গতকাল রোববার বেলা ১১টা থেকে রাঙামাটি শহরে ১৪৪ ধারা জারি প্রত্যাহার করেছে জেলা প্রশাসন। গতকাল দুপুরে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খানের সই করা এক গণবিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রাঙামাটি পার্বত্য জেলার পৌরসভা এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ মোতাবেক ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় রোববার বেলা ১১টা থেকে থেকে রাঙামাটি পৌরসভা এলাকায় জারিকৃত ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করলাম।
এদিকে দুপুরে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করার পর রাত ৮টার দিকে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে প্রশাসনের আশ্বাসে রাঙামাটিতে ডাকা অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনসমূহ। তবে ৭২ ঘণ্টার সড়ক ও নৌপথ অবরোধ বলবৎ আছে। পরিবহন ধর্মঘট ও অবরোধের দ্বিতীয় দিন গতকালও রাঙামাটি শহরের অভ্যন্তরীণ একমাত্র যানবাহন সিএনজিচালিত টেঙি চলাচল করেনি। বন্ধ ছিল দূরপাল্লার যানবাহন ও কাপ্তাই হ্রদে লঞ্চ চলাচল। এদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাঙামাটি জেলা শহরে সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার দোকানপাট, বনরূপা বাজার, বসতবাড়ি, মসজিদ, বিহারসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয় পরিদর্শন করেছে প্রশাসন। এ সময় রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান, পুলিশ সুপার ড. এসএম ফরহাদ হোসেন, সেনাবাহিনীর রাঙামাটি সদর জোন কমান্ডার এরশাদ হোসেন চৌধুরী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জোবাইদা আক্তারসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। তারা ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলেন।
শহরের প্রাণকেন্দ্রে সহিংসতার পর গত শুক্রবার দুপুর থেকে রাঙামাটি শহরে মানুষের উপস্থিতি কম লক্ষ্য করা গেছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘর থেকে বের হননি। শনিবারের তুলনায় গতকাল সকাল থেকে শহরের বনরূপা বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় মানুষের উপস্থিতি কিছুটা বেড়েছে। কিছু দোকানপাটও খুলেছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে।
উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটিতে জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্তি চায় ইউপিডিএফ : রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও চারজন নিহতের ঘটনায় সরকার ঘোষিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটিতে জাতিসংঘকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। গতকাল সকালে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি নতুন কুমার চাকমা বলেন, জাতিসংঘের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি ছাড়া অন্য কোনো তদন্ত কমিটি পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তিনি বলেন, জুলাই–আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় ফ্যাসিস্ট হাসিনার নির্দেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তের জন্য জাতিসংঘকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে তা সম্ভব না হওয়ার পেছনে কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তের জন্য জাতিসংঘকে যুক্ত করা না হলে তা হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক ও অপরাধীদের দায় মুক্তি দেওয়ার সামিল।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি জনসংহতি সমিতির : পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদনের দীর্ঘ প্রায় ২৭ বছরেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত রাখায় পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি’ বর্বরোচিত হামলার ঘটনা বারবার ঘটিয়ে ফায়দা লুটছে বলে মনে করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা)। দলটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছে। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দাবি জানিয়েছে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ–সাধারণ সম্পাদক সুদর্শন চাকমা।
খাগড়াছড়িতে অবরোধের দ্বিতীয় দিনে যান চলাচল বন্ধ : খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে হামলা, খুন ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র–জনতার ডাকা ৭২ ঘণ্টার অবরোধ চলছে। অবরোধে দ্বিতীয় দিনেও খাগড়াছড়ির সাথে রাঙামাটি, ঢাকা ও চট্টগ্রামের সাথে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ ছিল। এছাড়া দীঘিনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙাসহ আন্তঃউপজেলাগুলোতে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
ঢাকায় বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র–জনতার আয়োজিত সমাবেশ থেকে ঘোষিত তিন পার্বত্য জেলায় ৭২ ঘণ্টা সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচির প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়েছে আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ। অবরোধের সমর্থনে সকালে খাগড়াছড়ি সাজেক সড়ক, মানিকছড়ি, রামগড় সড়কে টায়ার ও কাঠে আগুন দিয়ে বিক্ষোভ করেছেন অবরোকারীরা। তবে কোথাও কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল বলেন, সহিংসতা এড়াতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সড়ক সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে।
অবরোধে সাড়া নেই বান্দরবানে : বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, খাগড়াছড়ি–রাঙামাটিতে সংঘাতের ঘটনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ৭২ ঘণ্টা সড়ক ও নৌপথ অবরোধের দ্বিতীয় দিনেও বান্দরবান জেলায় তেমন প্রভাব পড়েনি। গতকাল সকাল থেকে বান্দরবান থেকে ছেড়ে গেছে চট্টগ্রাম–ঢাকা ও কঙবাজার জেলার উদ্দেশ্যে গণপরিবহন। জেলা সদরসহ অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতেও যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক ছিল। কোথাও কোনো ধরনের পিকেটিং করতে দেখা যায়নি। সব ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও খোলা ছিল। স্বাভাবিক ছিল জীবনযাত্রা।
অভ্যন্তরীণ পরিবহন মালিক সংগঠনের নেতা নূর আলম জানান, বান্দরবান জেলার সাতটি উপজেলায় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক ছিল। কোথাও কোনো ধরনের সমস্যাও হয়নি। এদিকে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে জেলা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন ছিল।