স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু

রাশেদ রউফ | শনিবার , ৩ আগস্ট, ২০২৪ at ৬:২৪ পূর্বাহ্ণ

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একসময় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘বাঙালির কোনো ইতিহাস নেই’। এই দুঃখ ছিল অনেকের। কিন্তু বাঙালির শত বছরের পরাধীনতার গ্লানি, পুঞ্জীভূত কালিমা ও অপমান অপবাদের অবসান ঘটাতে আবির্ভূত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এসেই সৃষ্টি করলেন ইতিহাস। যে ইতিহাস বাঙালির।

একজন ছাত্রকর্মী থেকে স্বাধীন দেশের স্থপতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে তাঁর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। এসেছে বাধা, এসেছে প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু সমস্ত বাধা অতিক্রম করে তিনি পৌঁছে গেছেন তাঁর গন্তব্যে। সঙ্গে ছিল জনগণের ভালবাসা। ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান পুরো মাত্রায় রাজনীতির নেতৃত্বে নেমে পড়েন। চোখের সামনে যা কিছু অন্যায়, বঞ্চনা ও শোষণ দেখতে পেয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন অকুতোভয়ে। কিশোর বয়স থেকে তাঁর বুকে যে দ্রোহের আগুন জ্বলছিল, তা আরো প্রগাঢ় হয়ে ওঠে। কারা লুটেপুটে খায় বাংলার সম্পদ? কারা কেড়ে নেয় বাংলা মায়ের সুখ ও শান্তি? শৃঙ্খলিত স্বদেশভূমিকে পরাধীনতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার দুর্জয় শপথ নিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পুরো জাতিকে জাগিয়ে তুললেন। বাংলার মানুষের জন্যে তাঁর আন্তরিক দরদ ও উদারতা রূপ নিয়েছে কিংবদন্তিতে।

মোনায়মে সরকারের ভাষায়, ‘বঙ্গবন্ধু যে একজন অসম সাহসী মানুষ ছিলেন তা এখন কারও অজানা নয়। এই সাহসের উৎস যদি আমরা খুঁজতে যাইতাহলে দেখা যাবে মানবপ্রেম আর দেশপ্রেমই মূলত তাকে সাহসী হওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। মানবতার অবমাননা হচ্ছে, মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এরকম ঘটনা চোখে পড়লে ছোটবেলা থেকেই শেখ মুজিব প্রতিবাদ করতেন।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। কেন চাইলেন এই স্বাধীনতা? অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ বলেছেন, খোকা যেমন মাকে চায়, আকাশ যেমন নীল চায়, আর বসন্ত যেমন গান চায়। মুজিব তেমনি স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। মায়ের মতো স্নিগ্ধ যে দেশ সেই দেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন সর্বক্ষণ। মুজিবের এই স্বাধীনতা চাওয়ার জন্য তাঁকে অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। কারাবাস করতে হয়েছে বারবার। অনেকবার। সকালে গ্রেফতার করলে বিকেলে ছাড়ে। আবার বিকেলে করলে পরের দিনও ছাড়ে। কখনো দীর্ঘদিন। হিসেব করে দেখা গেল জীবনের চৌদ্দ বছর কাটলো তাঁর কারাগারেই। মৃত্যুর হাত থেকেও ফিরে এসেছেন তিনি। নিশ্চিত মৃত্যু। ফাঁসি তৈরি। ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে এটি বিবেচিত। বাংলার ভালবাসা মুজিবকে বাঁচালো। আবার মুজিব এসে বাংলাকে মুগ্ধ করলেন।

১৯৬৯ সালে পূর্ব বাংলায় গণজোয়ার সৃষ্টি হল। সৃষ্টি হলো গণঅভ্যুত্থান। সেই সময় হাজার কন্ঠে উচ্চারিত হয়: ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর,’ ‘আমাদের সংগ্রাম চলছেই চলবে।’ এসব স্লোগানের সঙ্গে আরেকটি স্লোগান শোনা যেত; ‘এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।’ হ্যাঁ বঙ্গবন্ধুই নেতা, যিনি গোটা বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারী। তিনিই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বাংলার মুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানালেন। ডাক দিলেন স্বাধীনতার। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। এই আন্দোলন ছিল বহু বিজ্ঞ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। এই আন্দোলন চালিয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান চক্রকে অসহায় করে তুলেছেন যেমন, তেমনি বিশ্ববাসীর কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন, বাঙালি শান্তিপ্রিয় জাতি। পাকিস্তানিদের যাবতীয় শোষণ, অত্যাচার, অবিচার ও নির্যাতনের জবাব দিচ্ছে রক্তপাতহীন, অহিংস অসহযোগ আন্দোলন দিয়ে। এই আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। এই আন্দোলনের মুখে বিপর্যস্ত পাকিস্তানি চক্র ২৫ মার্চ রাতে শেষ পর্যন্ত কামান বন্দুক নিয়ে বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নৃশংসতম হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে তারা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে গড়ে ওঠে প্রতিরোধ। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধে বাঙালি দেখাতে পেরেছিল তাদের সাহস ও শক্তিমত্তা। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১এ লজ্জাজনক আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিতাড়িত হলো পাকিস্তানি বাহিনী। পৃথিবীর বুকে জন্ম হলো নতুন একটি দেশ ‘বাংলাদেশ’। তাই বঙ্গবন্ধু শুধু একজন ব্যক্তি নন, একটি আন্দোলন। একটি প্রতিষ্ঠান। একটি বিপ্লব। একটি অভ্যুত্থান। জাতি নির্মাণের কারিগর। মহাকালের অমরগাথা। একটি স্বাধীন দেশ। একটি ইতিহাস।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। আমরা সার্বভৌম বাংলাদেশ পেতাম না। বাঙালি জাতির নির্দিষ্ট মানচিত্রও তৈরি হতো না। আজকে আমরা বাংলাদেশ পরিচয়ে বিদেশের দূতাবাসে, জাতি পরিচয়ে কর্মযজ্ঞ চালাতে পারতাম না। তাই বঙ্গবন্ধুর এ ঋণ কোনো দিন শোধ করার নয়।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধ১৪ দিন পর চট্টগ্রাম থেকে ছাড়ল ট্রেন
পরবর্তী নিবন্ধদামপাড়ায় পুলিশ বক্স ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নামফলক ভাঙচুর