স্বাধীনতার জয় ও নারীর সূত্রতা

সাজেদা আনজুম | শনিবার , ২৪ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:২৮ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতা যেন সমুদ্রে জমানো চোরাবালির হাজারো কথা। ভাষার প্রশ্নে বাঙালি খুঁজে নিয়েছিলো নিজের একক পরিচয়, নিজের জাতিকে। স্বাধীনতা যেন মুছে দিয়েছে সকল ভেদাভেদ। তবুও আজ আমরা খুঁজে ফিরব আমাদের দেশের জননীকে, যারা সূর্যের প্রথম কিরণে বাংলাকে একটি দেশ হিসেবে এনে দিয়েছে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে কোনো দল,বর্ণ,গোত্রের একক অবদান আছে তা কখনোই বলা যায় না। সর্বস্তরের মানুষের সম্বলিত প্রয়াসে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। এ-সংগ্রামে পুরুষের সাথে নারীরাও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। সিতারা বেগম, তারামন বিবি, কাঁকন বিবি, রমা চৌধুরী, ভাগীরথীদের মত অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধারা দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চট্টগ্রামের দীর্ঘ ঐতিহ্যর নারীর সে দীর্ঘসূত্রতার কথা না বললেই যেন নয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষা সৈনিক বেগম মুশতারী শফী যার মধ্যে অন্যতম। ‘শহীদ জায়া’ নামে খ্যাত মুশতারী শফি একজন বরেণ্য সাহিত্যিকও বটে। তিনি বাংলার অন্যতম নারীনেত্রী ও ভাষাসৈনিক। চট্টগ্রামের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও এ-অঞ্চলের মানুষের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। এ-মহান সংগ্রামী নারী অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে ছিলেন আমৃত্যু সোচ্চার এক যোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা মুশতারী শফী ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি তার পিতার কর্মস্থল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা খন্দকার নাজমুল হক তৎকালীন ভারতবর্ষের ডিএসপি ছিলেন। মা আরেফা খাতুন। মুশতারী শফীর দাদা খন্দকার হেলাল উদ্দিন, যিনি সিপাহী বিদ্রোহে পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং নানা কাজী আজিজুল হক ব্রিটিশ ভারতীয় পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন।

তাই বলা যায় পারিবারিক সূত্রে তিনি শৈশবকাল থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, স্বাধীনতাকামী মন যেন তার রক্তেই প্রবাহমান। এছাড়াও তিনি সর্বদা নারীর অধিকার নিয়ে সচেতন ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে কখনই কাল হয়ে দাঁড়াতে দেননি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ না পেলেও ঘরে বসেই তালিম গ্রহণ করেছেন। কম বয়স থেকেই লেখালেখির জগততাকে আকৃষ্ট করে। লেখালেখির জগতে নিজেকে ডুবিয়ে নিয়ে, মাত্র এগারো বছর বয়সে দৈনিক আজাদী পত্রিকায় ছোটদের আসর, মুকুলের মাহফিল-এ ছোটগল্প লেখার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন।
১৯৫৫ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি মোহাম্মদ ডক্টর শফীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হোন। শৈশবে বিয়ে হলেও সংসারের বেড়াজালে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেননি। স্বামী ড. শফি সবসময় তাকে শিক্ষাগ্রহণ ও সাহিত্য গ্রহণে উজ্জীবিত করেন।
মুশতারী শফি নারী মুক্তি আন্দোলনের সাথে সর্বদা যুক্ত ছিলেন। ষাটের দশকে তিনি গড়ে তুলেন ‘বান্ধবী সংঘ’ নামের একটি সংগঠন। যা ছিলো চট্টগ্রামের প্রথম নারী সংগঠন। যেখানে ধনী-গরিব নারীরা নিঃর্বিশেষে সাহিত্যচর্চা করতে পারেন। ১৯৬৯ সালে তিনি চট্টগ্রামে মেয়েদের প্রেস নামক একটি ছাপাখানাও প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে শুধুমাত্র নারীরাই কাজ করতেন। এ-যেন পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহের সামিল। একই দশকে মেয়েদের প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় ‘বান্ধবী’ নামক একটি মাসিক পত্রিকা যার সম্পাদক ছিলেন মুশতারী শফী নিজেই। এছাড়াও ‘উমরতুল ফজল’, ‘সালেহা জহুর’,’আইনুন নাহার’ সহ জনকয়েক লেখিকা ও সাংবাদিককে একত্র করে মানসম্মত পত্রিকা প্রকাশের অগ্নি-পরীক্ষায় নেমেছিলেন, যা সে দশকে কঠিনই বটে। তিনি এগারো বছর ধরে সফলভাবে পত্রিকাটি প্রকাশ করেছেন। ১৯৭০ সালে তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের চট্টগ্রাম শাখার আহ্‌বায়ক নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দেশের অন্যতম একটি প্রাচীন নারী সংগঠন। এর উদ্দেশ্য ছিলো নারীর বিরুদ্ধে সকল সহিংসতা প্রতিরোধ ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি এবং নারীর মানবাধিকার সুনিশ্চিত করা যা নীতিনির্ধারণে নারীর সক্ষমতা ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে মুশতারী শফী ও তাঁর পরিবার অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন । বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামে পথিকৃৎ ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১১ মার্চ মহিলা সমিতির পৃষ্ঠপোষকতায় চট্টগ্রামের জে.এম.সেন হলের বিশাল সমাবেশে বেগম মুশতারী শফী বলেন এখন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের সবারই এগিয়ে আসার সময়। পাকিস্তানি স্বৈরাচার থেকে অধিকার আদায় করে নেওয়ার সময়। আমাদের ছেলে-মেয়েরা,আমাদের ভাইয়েরা স্বৈরাশাসক পাকিস্তান থেকে নিজের দেশকে কেড়ে নিতে জীবন উৎসর্গ করছে সে বায়ান্ন সাল থেকে আজ অব্দি। তবুও আমরা সম্পূর্ণ অধিকার আদায় করতে পারিনি। তবে এবার পারব। সংগ্রামী মা ও বোনেরা আসুন আজ আমরা ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলি এবং ঘর ছেড়ে এসে দাঁড়াই আমাদের স্বামী-সন্তান ও ভাইদের পাশে।
মুশতারী শফী নিজেও মুক্তিযুদ্ধকালীন তার ভাই ও স্বামীর পাশে সর্বদা ছিলেন। এছাড়াও তিনি যুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিবাহিনীকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক আলোচনায় ভূমিকা রাখেন। ভাষাসৈনিক বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধের আশ্রয়কেন্দ্র, অর্থ সাহায্য কাজে নিয়োজিত ছিলেন মুশতারী শফি। ৭ এপ্রিল মুশতারী লজ থেকে তার স্বামী ও ভাই আহসানুল হককে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত তারা নিখোঁজের তালিকায়। তরুণ বয়সে স্বামী ও ভাইকে হারিয়ে, অশ্রু মনে দমে যাননি এ-সাহসী ও উদ্যমী নারী। শিশু সন্তানদের নিয়ে চরম দুর্দশায় দিনযাপন করেন। পরবর্তীতে তিনি কোলকাতায় চলে যান এবং স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে যোগদান করেন। সেখানে ‘উম্মে কুলসুম’ ছদ্মনামে কবিতাও পাঠ করতেন।
বাংলায় স্বাধীনতার স্বাদ এনে যেন নিজেও সৃজনশীল কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। জীবনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ সময় দিয়েছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। সাহিত্য রচনাতেও তার হাত সকলকে ঈর্ষান্বিত করবে। তার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ হলো ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’, ‘চিঠি-জাহানারা ইমামকে’, ‘স্বাধীনতা আমার রক্তে ঝরা দিন’। এছাড়াও প্রবন্ধ রচনা, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, কিশোর গল্পগ্রন্থ, স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ রচনা করে বাংলাকে দিয়েছেন মূল্যবান সাহিত্যের ছন্দ।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পরেও নব্বই দশকেও তিনি দেশজুড়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যে আন্দোলন করে গিয়েছেন। বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রাখার জন্যে ‘২০১৬’ সালে বাংলা একাডেমির ‘ ফেলোশিপ’ উপাধি অর্জন করেন। ২০২০ সালে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘রোকেয়া পদক’।
স্বাধীনতা যেন হাজার মায়ের কান্না, বুকহারা হৃদয়ের সুর। তবুও সকল কিছুকে ছাপিয়ে বেগম মুশতারী শফী একজন একক চরিত্রে বাংলার বুকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, চট্টগ্রামের ইতিহাসে নারীমুক্তির স্বীকৃত পথ তৈরি করে দিয়েছেন। নক্ষত্রেরও মৃত্যু হয়, এ-বাক্য আবারো প্রমাণ করলো ২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর ৮৩ বছর বয়সে আমাদের মুশতারী শফীর মহাপ্রয়াণে। মহান বিজয়ের মাসে, দেশের স্বাধীন পথ চলার পথে মুশতারী শফীকে স্মরণ যেন আজ সবচেয়ে বড় বিবেকের পরিচয়। সকল শহীদ, বুদ্ধিজীবীদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান
পরবর্তী নিবন্ধচবি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজন ইন্টার-একশন সেশন