বাঙালি স্বভাবজাত স্বপ্নময় একটি জাতি। স্বপ্ন দেখতে এবং তা যৎপরোনাস্তি গড়তেও ভালোবাসে, আবার ধূলিসাৎ করতেও পিছপা হন না। বাঙালিদের এ দোটানা স্বভাব আজকের নয়। প্রায় হাজার বছরের বাঙালি বিভিন্ন ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়েছে। সমতট হরিকল পূর্ববঙ্গের বাঙালি কিংবা গৌড় উত্তর বঙ্গের বাঙালি অবশেষে স্বাধীন ভূখণ্ডের কিংবা রাষ্ট্রের দিক থেকে আজ বাংলাদেশি। বাঙালির মধ্যে নদীর মতো উদ্দাম ও উদারতা আছে। আবার দুর্বলতাও কম নেই। প্রাচীন কাল থেকে তার জ্ঞান গরিমার জায়গাগুলো নিরর্থক অহংবোধে আক্রান্ত। ফলে সর্বক্ষেত্রে সাহস বীর্যবান ঐশ্বর্যের ক্ষেত্রগুলোতে ইতিবাচক হলেও মননে ও মেধায় স্থির লক্ষ্যে পৌঁছুনোর ব্যাপারে কুণ্ঠিত। নৃতাত্ত্বিক বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একাত্তর এর যে বোধে রয়ে গেছে তা হলো ভৌগোলিক অর্থে স্বাধীনতা। যে স্বাধীনতা ও সাম্যের জন্য এত বড় আত্মত্যাগ বা যে অর্থনৈতিক মুক্তি তা বাঙালির হয়েও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ থেকে গেল। কিন্তু এক ভাষাভাষী অঞ্চলের জনগোষ্ঠী এবং একই সাংস্কৃতিক স্বাজাত্যবোধের অন্তর্গত জনগোষ্ঠী দু’বার স্বাধীনতা পায় না। পাওয়াটা যৌক্তিকও নয়। একাত্তর এ ভৌগোলিক যে স্বাধীনতা প্রাপ্তি এবং স্বাধীনতা উল্লাস পরবর্তী দেশপ্রেম ঠিক ততটা গুরুত্ববহ ও প্রবল হয়ে উঠেনি। বোধ করি সে কারণে আমরা এখনো অনেকে পশ্চাতে অবস্থান করছি। কী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সামাজিক ক্ষেত্রে, কিংবা বিশ্বের বিবিধ দেশে আন্তঃসম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে। আরো এগিয়ে এসে বলা যায়, এশিয়াভুক্ত অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় আমরা দেশ পরিচালনা ও আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে অনেক দূর পিছিয়ে। এ সমস্ত পশ্চাৎপদতার কিছু কারণ আছে বলে মনে হয়।
এক. আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছি। স্বাধীন বাংলাদেশও গঠন করেছি কিন্তু চরম মূল্যে প্রাপ্ত স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার ও রক্ষায় ততটুকু মনোযোগী হতে পারিনি।
দুই. ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক আকল্পকে ভেঙে স্বাধীনতাকে ভোগ করেছি আনন্দের উপকরণে। নাগরিক হিসাবে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকে বিনিময়ে কোন কিছু প্রদানের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থেকেছি।
তিন. যে বোধ ও প্রেরণার উৎসস্থল থেকে স্বাধীনতাকে তৈরি করেছি অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক তৎপরতায়; এতে উল্লেখযোগ্য কাজ করতে পারিনি।
চার. সেক্যুলারিজম রাষ্ট্রের বিবিধ ঘটনার অভ্যন্তরে অন্ধকারাচ্ছন্ন হ‘য়ে রইলো। মসজিদ ও মন্দির থেকে ধর্ম রাজপথে এসে রাজনীতির মূল স্রোতে মিশে গেছে। উপনিবেশোত্তর আমাদের ভাবকল্পনা ছিল প্রতিটি বাঙালির স্বপ্ন হবে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে দৃঢ় অঙ্গীকার এবং উর্বর মননের অনুশীলনের ফলে বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রগুলোর পরিবর্তন। মানবাধিকার রক্ষার ব্যাপারে সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র যুগোপযোগী হওয়া। স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশের কাছে জনগণের এ প্রত্যাশাও অযৌক্তিক নয়, কারণ যে রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাঙালির উন্মেষ, তাতে এরকম পাওয়ার ব্যঞ্জনাটা দোষের কিছু না। অথচ মুক্তিযুদ্ধের যে সাহসিক চেতনা ও গরিমা দিয়ে বাঙালি আত্মমর্যাদাশীল জাতিতে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে চেতনা আজ অবহেলিত, সর্বোপরি পযুর্দস্ত। স্বাধীনতা উত্তর বাঙালির রাজনীতি আজ দুরাচারে পরিণত হয়েছে। আমরা ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ৭১ এর যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালিকে বিশ্বের দরবারে বীরের জাতি রূপে পরিচিত করেছি। এ অর্জন কেবল রাজনীতির প্রবল সদর্থক ব্যবহারের কারণে সম্ভব হয়েছে। সে ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পরবর্তী গণতন্ত্রের কোথায় অবস্থান জনগণ টের পেয়ে গেছে। মুখে গণতন্ত্রের সশ্রদ্ধ বুলি, বুদ্ধিতে দখলদার স্বৈরাচারী ক্ষমতালোভী একরোখা রাজনীতির দৌরাত্ম্য। না দলের ভিতরে না আচরিত দেশনীতি ও সমাজনীতির ওপর তার কোন শুভ প্রভাব পড়ছে। দেশের এরকম একটি চিত্র যে কেউ অনায়াসে খাড়া করে দিতে পারে। তাহলে উপনিবেশকে আঘাত করে, তাদের সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে, যে দেশ আমরা পেয়েছি তাতে জনগণ কিংবা দেশের কি লাভ হলো? একাত্তর এর ভৌগোলিক স্বাধীনতা কেবল আমাদের প্রাপ্তি ছিল না, এতে জড়িয়ে ছিল আমাদের অফুরন্ত সম্ভাবনা। আমাদের সাহিত্য, চিত্রকলা, সংস্কৃতি উর্বর হবে। মনন চর্চায় বাঙালির পরিচয় উর্ধ্বে উঠে, লালন, হাছন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, শামসুর রাহমান, মোহাম্মদ রফিক, আরো বহু গুণী ব্যক্তিত্বের সমাগমে আজকের উত্তরাধিকার পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। অথচ আজ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নামে মদদ পুষ্ট হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। সমাজ সেবার নামে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে বিদেশি সাহায্য সংস্থা ও এনজিও। ভোলেন্টারী সার্ভিসের নামে ইউরোপীয় কায়দায় এখানেও গড়ে ওঠছে বিভিন্ন সেবা সংস্থা। সমাজ গুরুদের মধ্যে ঔপনিবেশিক শিক্ষা–দীক্ষার প্রসার। শিক্ষার নামে অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণির শিক্ষকের সমবায়ে অজস্র কিন্ডার গার্টেন প্রতিষ্ঠা এবং তরুণ–তরুণীদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। এসমস্ত হলো স্বাধীনতা উত্তর অর্জনের নেতিবাচক ইস্তেহার! প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা উত্তর বাঙালি সংস্কৃতিকে ঔপনিবেশিক উত্তর দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। কিছুটা সাংস্কৃতিক কর্মীদের কারণে, কিছুটা দ্বিধা বিভক্ত রাজনীতির অসম ক্ষমতা ও দম্ভের ফলে। শিল্প সাহিত্য উত্তরণের ক্ষেত্রে ৮০ এর মধ্য ভাগে এসে সঠিক জায়গা বেছে নিতে সমর্থ হলেও একুশ শতকের প্রারম্ভে এসে তাকেও দোটানায় গড়াতে হচ্ছে। আমাদের কথাসাহিত্য, কবিতা, প্রবন্ধ সাহিত্যে স্বাধীনতার স্বপক্ষে যে আচরিত জীবন বোধের ক্ষেত্রগুলো বিস্তৃত হতে চলেছে, সে জায়গায় পরিণত বীজ না ফলানোর আগে কুঠারাঘাত করা হচ্ছে। অথচ স্বাধীনতার তিন দশক পরে এসে যজমান তরুণরা বাঙালি জাতিতত্ত্বের ঘরানা থেকে কবিতা, গল্প উপন্যাসকে বুর্জোয়া শ্রেণি চরিত্রের ঘেরাটোপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা পূরণের বাস্তবায়ন শুরু করেছিল। এ কাজ তারা করছে প্রান্ত থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত। এ জায়গায় নতুন করে উদ্দীপক হয়েছিলো নিম্ন বর্গীয় মানুষ, তাদের আশাআকাঙ্ক্ষা, সুখ–দুঃখ এবং আদিবাসী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনা। কারণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিলো এদেশের মাঠের কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ। স্বাধীনতার বেনিফিশিয়ারি হবে সে–সব খেটে–খাওয়া মানুষ। স্বাধীনতার উদ্দীপক ও শিল্প সাহিত্যের চরিত্র হওয়া উচিত ছিলো তাদেরই। অথচ নিম্নবিত্তদের আমরা দূরে ঠেলে দিয়েছি। শূন্যতা ও বিমূর্ততার চর্চা করে আমরা মাটি ও কৃষক থেকে দূরে সরে আছি। এতো গেলো শিল্প সাহিত্যের অবধারণাগত বিন্যাস। স্বাধীনতা উত্তর আমাদের অর্থনীতিও যুৎসই কোনও জায়গায় দাঁড়াতে পারেনি। দাঁড়াতে না পারার কুফল দীর্ঘ ঔপনিবেশিকতা। অথচ ব্রিটিশ ভারতের অর্থনীতি ছিল সম্পূর্ণভাবে তাদের কল্যাণে নিয়োজিত। অর্থাৎ একটা কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। কিন্তু সদ্যজাত পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তি যেহেতু এক শ্রেণির রন্ধ্রে রয়ে গেছে সে কারণে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রধারণা বাঙালির চর্চা থেকে দূরে সর্বদা। পাকিস্তান রাজনৈতিক সুশাসনের অভাবে অর্থনীতির বারোটা বাজিয়েছে। ঔপনিবেশোত্তর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে জাগরণের সম্ভাবনা ছিল, তাও অপসৃয়মান প্রায়। হাতেগোনা কয়েকটি বড় কোম্পানির কাছে আমাদের অর্থনীতি জিম্মি হয়ে আছে। সে কারণে একটি ভঙ্গুর ভাসমান অর্থনীতির ওপর পুরো জনগোষ্ঠীর ভাগ্য জড়িয়ে আছে। আর্থ–সামাজিক মুক্তি বলতে যে চিত্র সচরাচর আমরা বুঝে থাকি, তা থেকে অনেক দূরে আমাদের অবস্থান। স্বাধীনতা–উত্তর আমাদের দেশে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী হয়েছে সত্যি, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে অনেক বেকার যুবক–যুবতির কর্মের সংস্থানও হচ্ছে, কর্ম পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। তারপরও ব্যাপক ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিজ প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার কারণে আমরা পুরোপুরি এই শিল্পে সফলতা পাইনি। অধিকন্তু ইউরোপীয় ও আমেরিকার বিবিধ নিষেধাজ্ঞার কারণে গার্মেন্টস শিল্প বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। শোনা যাচ্ছে ইউরোপ আমেরিকা গার্মেন্টস অর্ডার বন্ধ করে দেবে। অন্য যে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, তাদেরও ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’এর মতো অবস্থা। পুঁজির সংকটের কারণে বিনিয়োগ করতে পারছে না। ব্যাংক ঋণ সহজ লভ্য নয়। ব্যাংকে নগদ অর্থের ক্রাইসিস শুরু হয়েছে খেলাপি ঋণের কারণে। একথা স্মর্তব্য যে পাশ্চাত্য শিল্প বিপ্লবের পর বিভিন্নভাবে পুঁজিকে তারা ব্যবহার করেছে। যখনই পুঁজি কোন জায়গায় মুষড়ে পড়েছে, তখনই তারা পুঁজির খোলনলচে পাল্টে ফেলেছে। পশ্চিমের সামাজিক ডিসকোর্সে আজকাল উত্তর পুঁজিবাদ প্রসঙ্গ বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। এই ডিসকোর্স আধুনিক পুঁজির ব্যবহারকে স্বীকার করেও তার নতুন বিন্যাস ও ব্যবহারের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এই উত্তর পুঁজিবাদ অবশ্যই বৃহত্তর অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। কেন্দ্রের সঙ্গে প্রান্তের অবস্থান। বৃহৎ উদ্যোক্তার সঙ্গে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার একটি যোগসূত্র স্থাপন। সেই সঙ্গে উত্তর পুঁজিবাদে আজকাল বিশ্বায়নের আরো একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। এখন বলা হচ্ছে বিশ্বায়ন মানে বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থায় সকলের অংশগ্রহণ। একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে পুঁজি বিনিয়োগ না হয়ে তা হবে বিশ্বের নানান জায়গা থেকে এবং তা সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হবে অঞ্চল ভিত্তিক সামর্থ্যের ওপর। আমরা অনুরূপ কোনও পুঁজির কথা হয়তো, এ মুহূর্তে ভাবতে পারবো না তথাপিও আমাদের যা পুঁজি আছে তার যথার্থ ব্যবহারে কেন্দ্র ও প্রান্তের সঠিক নির্ণয়ে যথোপযুক্ত স্থানে ব্যবহারে হয়তো সুফল পাবো। তবে অবশ্যই তা পাশ্চাত্য আঙ্গিকে নয়। মৌলিক চাহিদার আবশ্যিকতা নিজের দেশের আঙ্গিকে তা করতে হবে। তা হলে এই নিবন্ধে এই বিবেচনায় কি আসা যায়, বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকে মহীয়ান করার জন্য আরো একবার স্বাধীনতা পাওয়া উচিৎ, ভৌগোলিক অর্থে নয়, মনোজগতের ভিতরে লালিত অসুস্থ উপনিবেশকে সমূলে কুঠারাঘাত করে হাজার বছরের বাঙালি ঘরানায় একটা ব্যবস্থাপনা। আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন ছিল উৎপাদনমুখী একটা অর্থবিশ্ব এবং সাংস্কৃতিকবিশ্ব। যেখানে স্বাধীনতা তৈরি হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ঠিকানা ও শুভেচ্ছা অনুভবে।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক