স্বল্প-কার্যকর ভ্যাকসিন-নেব কি নেব না?

সুমিত মজুমদার এবং তাপস মণ্ডল | মঙ্গলবার , ২৭ এপ্রিল, ২০২১ at ২:৫০ পূর্বাহ্ণ

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবীজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে SARS-CoV-2 এবং এই ভাইরাসজনিত রোগ কোভিড-১৯, যা ইতিমধ্যে কেড়ে নিয়েছে ত্রিশ লক্ষেরও বেশি প্রাণ। ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে ভাইরাসটি আরো ভয়ংকর রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে দেশে দেশে। দিকে দিকে ধ্বনিত অসহায়ের হাহাকার এবং অগণিত মৃত্যুর মাঝে একটিই মাত্র আশার প্রদীপ হয়ে এসেছে কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন। প্রযুক্তির কল্যাণে এক বছরেরও কম সময়ের মাঝে কোভিড রোগের বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন তৈরি করা সম্ভব হলেও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে তাদের বিভিন্ন মাত্রার কার্যকারিতা দেখা গেছে। মডার্না, ফাইজার-বায়োএনটেক, এবং রাশিয়ার তৈরী স্পুটনিক ফাইভ যেখানে তাদের ভ্যাকসিন ৯০ শতাংশেরও বেশি কার্যকর বলে দাবি করছে, সেখানে জনসন অ্যান্ড জনসন এবং অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা (যেটি আমাদের দেশে প্রয়োগ করা হচ্ছে) ভ্যাকসিনের কার্যকারীতা ৬৫ শতাংশের মতো। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে যে আমরা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার আবিষ্কৃত যে ভ্যাকসিনটি দেশে পাচ্ছি তা কি তবে কম কার্যকর? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বলতে কি বোঝায় এবং তা কিভাবে পরিমাপ করা হয়।

একটি প্যাথোজেন (এবং সে জনিত রোগ)-এর বিরুদ্ধে কোনো ভ্যাকসিন কতটুকু সুরক্ষা দিতে পারে তার সম্ভাব্যতার পরিমাপই হলো ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বা এফিক্যাসি। আর এই এফিক্যাসি নিরুপন করা হয় ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে যেখানে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী অংশগ্রহণ করে। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশ নেয়া এই স্বেচ্ছাসেবীদের দৈবচয়নের (Random sampling) ভিত্তিতে দুইটি দলে ভাগ করা হয়। এক দলের উপর আসল ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা হয় এবং অন্য দলের উপর একটি ভ্যাকসিন-সদৃশ পদার্থ প্রয়োগ করা হয় যার কোনো রোগ প্রতিরোধ বা নিরাময় গুনাগুন নেই, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘প্লাসিবো’। ভ্যাকসিন এবং প্লাসিবো-প্রাপ্ত সকল স্বেচ্ছাসেবীদের মাঝে পরবর্তীতে কতোজন কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলো তা গণনা করা হয়। প্লাসিবোর চেয়ে ভ্যাকসিন পাওয়াদের মাঝে যদি কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা কম হয়, তাহলে সেই ভ্যাকসিনটিকে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় কার্যকর বলে মেনে নেয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, ফাইজার-বায়োএনটেকের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে তেতাল্লিশ হাজারের বেশি লোক অংশগ্রহণ করে, পরবর্তীতে যাদের মাঝে ১৭০ জন কোভিড আক্ৰান্ত হয়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যে এই ১৭০ জনের মাঝে ১৬২ জনই ছিল প্লাসিবোপ্রাপ্ত। বাকী থাকে কেবল ৮ জন অর্থাৎ ৫ শতাংশ যারা ভ্যাকসিন পাওয়ার পরেও কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলো। এই ফলাফলের উপর ভিত্তি করেই ফাইজার-বায়োএনটেক তাদের ভ্যাকসিন কোভিড প্রতিরোধে ৯৫ শতাংশ কার্যকর বলে দাবী করেছে।

ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রক্রিয়াটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে কয়েকটি ফ্যাক্টর এই ফলাফলে প্রভাব ফেলতে পারে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান পৃথকভাবে, বিভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থান এবং বিভিন্ন সময়কালে তাদের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে। যেমন, মডার্না তাদের সম্পূর্ণ ট্রায়ালটি করেছে যুক্তরাষ্ট্রে এবং অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ট্রায়াল ছিল মূলত যুক্তরাজ্য এবং ব্রাজিলে। ফাইজার-বায়োএনটেক আফ্রিকা, ইউরোপ এবং ল্যাটিন আমেরিকার কিছু দেশেও ট্রায়াল চালালেও তাদেরও পরীক্ষা ছিল মূলত যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক। এছাড়া মডার্না এবং ফাইজার-বায়োএনটেক তাদের ট্রায়াল চালিয়েছে গরমের সময় যখন যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড সংক্রমণের হার ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। অন্যদিকে, জনসন অ্যান্ড জনসন যে সময়ে তাদের ট্রায়াল চালিয়েছে তখন যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমনের ঢেউ প্রায় চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলো। এছাড়াও জনসন অ্যান্ড জনসনের ট্রায়ালের একটি বড়ো অংশ ছিল ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় যেখানে সংক্রমণের হার শুধু বেশিই ছিল কেবল তা নয়, সেসব স্থানে করোনা ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টগুলোও ছিল ভিন্ন। অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে যে জনসন অ্যান্ড জনসনের ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে কোভিড আক্রান্ত হবার ঝুঁকি ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি, যা তাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই সবধরণের ভ্যাকসিনের মাঝে সরাসরি তুলনা করতে বিশেষজ্ঞগণ সতর্ক করছেন। কারণ বিজ্ঞানসম্মতভাবে সকল ভ্যাকসিনের মাঝে তুলনা করতে হলে সকল ভ্যাকসিনকে সম্পূর্ণ একই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে, একই সময়কালের মাঝে এবং একই জিওগ্রাফিক লোকেশনে ট্রায়াল চালাতে হবে, যা দুরূহ ব্যাপার এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয়ও বটে।

এখানে বুঝতে হবে যে, কোভিড ভ্যাকসিনের উদ্দেশ্য শরীরকে SARS-CoV-2 বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রস্তুত করা। তাই কোনো ভ্যাকসিন যদি ৬৫ শতাংশ কার্যকর হয়, সেই ভ্যাকসিন পেয়ে কোন ব্যাক্তির কোভিড রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমে যায়। তবে তারও চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে ভ্যাকসিনপ্রাপ্ত ব্যক্তির শরীর SARS-CoV-2 বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রয়োজনীয় এন্টিবডি তৈরি করে রাখে। এতে করে পরবর্তীতে সংক্রমণ হলেও শরীর এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে লড়াই করতে পারে, ফলশ্রুতিতে হাসপাতাল ভর্তি বা মৃত্যুর মতো মারাত্মক পরিণতি এড়ানো যায়। আর এই জায়গায় সবকটি ভ্যাকসিনই বেশ কার্যকর বলে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে অর্থাৎ ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় ভ্যাকসিন পাওয়ার পরও কোভিড আক্রান্ত হয়েছে এমন ব্যক্তিদের প্রত্যেকেই কোন হাসপাতালে ভর্তি না হয়েই সুস্থ হয়ে উঠেছে অর্থাৎ কোভিড-১৯ জনিত হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যু ঠেকাতে সবকটি ভ্যাকসিনই প্রায় শতভাগ কার্যকর – আর এখানেই ভ্যাকসিনের সাফল্য।

এটা ঠিক যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং জনসন অ্যান্ড জনসন-এর ভ্যাকসিন প্রয়োগে খুবই অল্প কিছু (প্রতি ১০ লক্ষ ডোজে মাত্র কয়েকটি) ক্ষেত্রে রক্ত জমাট বাঁধার মতো জটিলতা দেখা গেছে যে কারণে কোনো কোনো দেশ এই দুইটি ভ্যাকসিনের ব্যবহার সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অনেক বিষেশজ্ঞই এই দুটি ভ্যাকসিনের ব্যবহার চালিয়ে যেতে পরামর্শ দিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র যেমন জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা এগার দিন স্থগিত রাখার পর ফের ব্যবহার শুরু করার অনুমতি দিয়েছে। তাছাড়া ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মডার্নার ভ্যাকসিনের তুলনায় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং জনসন অ্যান্ড জনসন-এর ভ্যাকসিন দুইটি সহজে সংরক্ষণযোগ্য এবং দামেও সাশ্রয়ী। আবার অন্যান্য ভ্যাকসিনের যেখানে দুইটি ডোজ প্রয়োজন হয়, সেখানে জনসন অ্যান্ড জনসন-এর একটি ডোজই যথেষ্ট – যা জনবহুল দেশগুলোতে দ্রুত টীকাকরণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। । ফলে পৃথিবীর অনেক দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং জনসন অ্যান্ড জনসন, এই দুইটি ভ্যাকসিনের বিপুল উপযোগিতা রয়েছে।

তাই সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে, হাতের কাছে কোভিড রোগের যে ভ্যাকসিনটিই পাওয়া যায়, তাই দ্রুত নিয়ে নিতে পরামর্শ দিচ্ছেন বিষেশজ্ঞগণ। সেসাথে, যেহেতু ভ্যাকসিন পেয়েও কোভিড সংক্রমণের সম্ভাবনা থেকে যায় এবং ভ্যাকসিন পেয়েও যারা কোভিড আক্রান্ত হয় তারাও SARS-CoV-2 ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে, তাই সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে কিছু অভ্যাস – যেমন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা, ঘরের বাইরে ফেসমাস্ক পরে থাকা, মুখে হাত না দেয়া, এবং সাবান দিয়ে হাত ধোয়া – আমাদেরকে এরপরেও মেনে চলতে হবে। আর এভাবে সবার সমবেত প্রচেষ্টায় খুব শীঘ্রই এই ভয়াবহ মহামারীকে জয় করবো আমরা, এটাই প্রত্যাশা।

সুমিত মজুমদার, পিএইচডি, পোস্টডক্টোরাল ফেলো, ডিপার্টমেন্ট অফ ই.সি.ই
ড. তাপস মণ্ডল, সহযোগী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অফ পেডিয়াট্রিক্স।
দু’জনই বর্তমানে কানাডার ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগাড়ির ধাক্কায় অফিস থেকে আর বাসায় ফেরা হলো না
পরবর্তী নিবন্ধদেশে উৎপাদিত অক্সিজেনেই পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব