আমাদের দেশে কোনোভাবেই স্বর্ণ চোরাচালান রোধ করা যাচ্ছে না। কিছুদিন পরপরই ধরা পড়ছে সোনার বার। গত ২৭ জানুয়ারি দৈনিক আজাদীতে ‘থামছে না স্বর্ণ পাচারকারীদের তৎপরতা’ শীর্ষক প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরসহ দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণ পাচারকারীদের তৎপরতা থামছে না। পাচারকারীরা নানা কায়দায় মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা চ্যানেল পেরিয়ে চালান তাদের গোপন গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। গত কয়েক বছরে ধরা পড়েছে অনেকগুলো চালান। তবে পাচারকারীদের চালানের কতটুকু ধরা পড়ছে, আর কতটুকুই বা পাচারকারীরা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা চ্যানেল ফাঁকি দিয়ে বাইরে নিয়ে যেতে পারছে, সে ব্যাপারে নিরাপত্তা কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না। গতকাল আবারও চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ধরা পড়ল সিগারেটের প্যাকেট থেকে ১৪টি স্বর্ণের বার। ধারণা করা হচ্ছে এই চালানও এসেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে। এই চালানটি প্রসঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, এর আগে এয়ার আরাবিয়ার একটি উড়োজাহাজ আমিরাতের শারজাহ থেকে শাহ আমানতে অবতরণ করে। এই ফ্লাইটেই এই চালান এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিমানবন্দরে বিভিন্ন সংস্থার তদারকি দেখে ভয়ে ব্যাগ থেকে বের করে কনভেয়ার বেল্টে রেখে যায় পাচারকারীরা। আর্থিক সচ্ছলতার আশায় লোভে পড়ে অনেকেই দুবাই গিয়ে নিজ পেশা ছেড়ে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু আড়ালেই থাকছে আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালান চক্র।
অন্যত্র প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চোরাচালানে জড়িতরা বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করা স্বর্ণ বাংলাদেশে নিয়ে আসছে। মূলত ভারতে পাচারের জন্যই বাংলাদেশে এ স্বর্ণ চোরাচালান করে আনা হচ্ছে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালান রুটের সবচেয়ে বড় করিডোরগুলোর একটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। যথাযথভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে সামনের দিনগুলোয় তা আরো মারাত্মক রূপ নেয়ার বড় আশঙ্কা রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, স্বর্ণ চোরাচালানে উড়োজাহাজের ক্রু, বিমানবালা, বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মী ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা সরাসরি জড়িত রয়েছেন। আবার অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বলছে, আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আর্থিক ও শুল্ক খাতের বিভিন্ন সংস্থার কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের প্রশ্রয় কিংবা তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা বা ব্যর্থতা ছাড়া স্বর্ণ চোরাচালান মহামারী আকার ধারণ করতে পারত না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের প্রধান শ্রমবাজার এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। ভারতে চোরাচালানের স্বর্ণের বড় একটি অংশও আসছে সেখান থেকে। সামপ্রতিক সময়ে বৈধ চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডি–হাওলায় প্রবাসীদের অর্থের বড় অংশ দেশে আসার অভিযোগ উঠেছে। আবার স্বর্ণ চোরাচালানেও লেনদেনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে হুন্ডি–হাওলাকেই চিহ্নিত করছেন পর্যবেক্ষকরা। সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি চোরাচালান কার্যক্রমেরও প্রধান ভর কেন্দ্র হয়ে উঠেছে লেনদেনের অবৈধ ও অপ্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যম হুন্ডি–হাওলা। এভাবে হুন্ডি–হাওলার দৌরাত্ম্য বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। প্রবাসীরা যেন বৈধ পথে দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণ করেন এজন্য তাদের উৎসাহিত করতে হবে। এর সঙ্গে দেশ যেন আন্তর্জাতিক স্বর্ণ পাচারের করিডোর হিসেবে ব্যবহার না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি দরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমাদের স্মরণে রাখা দরকার, এ ক্ষেত্রে কাজ করছে বড় ধরনের দেশি ও বিদেশি সিন্ডিকেট। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক চক্র বাংলাদেশকে সোনা চোরাচালানের বড় ধরনের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। এর আগে এমন খবরও সামনে এসেছে, যাদের চোরাচালান রোধ করার দায়িত্ব, তাদের মধ্যেও কেউ কেউ অবলীলায় জড়িয়ে পড়ছে সোনা চোরাচালান চক্রের সঙ্গে। চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকটি চক্রের সন্ধান পেয়েছিল গোয়েন্দারা।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মধ্যে শাহজালাল দিয়ে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ চোরাচালান হয়। এই চোরাচালান রোধে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সেখানে অনেক ঘাটতি থাকায় এটাকে গোড়াতেই গলদ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। খোদ বিমান মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনেও এমন তথ্য উঠে এসেছে। চোরাচালান রোধে গলদগুলো চিহ্নিত করে মতামত দেওয়ার পাশাপাশি কিছু সুপারিশও করেছে তদন্ত কমিটি। আমরা চাই, বাংলাদেশে স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।