ওরা তিনজন। বয়স ৪০ থেকে ৫৫। ওজন-উচ্চতার (বিএমআই) হিসাবে একদম নিচের প্রান্তিক সীমানায়। ছোটখাট গড়ন। ভাঙা ইট, সুরকির অন্তত ৫০ কেজি ওজনের বস্তা টানছেন। অ্যাপার্টমেন্টের ১১ তলা থেকে নিচে। তিন তিনটা লিফট থাকলেও ওদের লিফট ব্যবহারের সুযোগ নেই। এত ভারী বস্তা মাথায় সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করছেন।
বড় ছেলে বউমার কেয়ারে নিজেও কমপ্লেক্সটির বাসিন্দা। নগরকেন্দ্র কাজির দেউড়িতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ সিডিএ নির্মিত একমাত্র অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স এটা। বহুতল আবাসিক কমপ্লেক্সটি নিশ্চিত পরিবেশ বান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত। ৪র্থ তলা থেকে উপরে অ্যাপার্টমেন্ট শুরু। ৩য় তলা পর্যন্ত সিডিএ’র সুপার মার্কেট। মাটির নিচে তিনতলা বেসমেন্টও। মার্কেটের লিফট, সিঁড়ি সামনে মূল রাজপথ থেকে শুরু। আবাসিকের সাথে কোন যোগ নেই। মুখোমুখি অ্যাপার্টমেন্টেগুলোর মাঝখানে প্রায় ১৫ ফুট জায়গা ফাঁকা। এতে সবগুলো অ্যাপার্টমেন্টে স্বাভাবিক আলো-বাতাস খেলে। সুপরিসর কমপ্লেক্সটির প্রতি লেভেলে প্রশস্ত করিডর বা ওয়াকওয়ের ব্যবস্থা আছে। এগুলো দৈর্ঘ্য প্রায় শত মিটার প্রস্থে ৭ ফুটের মত। শরীরচর্চা বহু বছরের নিয়মিত অভ্যাস। ওয়াকওয়ে ধরে প্রতিদিন সকাল ১০ থেকে সাড়ে ১০ টা পর্যন্ত ৭ম ও ১০ম লেভেল হাঁটাহাঁটি করি। হাঁটাহাঁটির পর ছাদে রোদস্নান ও হালকা ব্যায়াম। এসময়ে ওরা চোখে পড়েন। সিডিএ’র নিজস্ব নক্সায় নির্মিত অ্যাপার্টমেন্টগুলো সম্ভবত ‘১৪ সালে লটারির মাধ্যমে বন্টিত হয় নির্ধারিত দরে। চাবি বুঝিয়ে দেয়া হয় ২০১৯ সালের নভেম্বরে। কিন্তু লটারি বিজয়ীদের অনেকেই ফ্ল্যাট আগেই তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করে দেন। কিছু বরাদ্দপ্রাপ্ত টাকা পরিশোধ না করায় এখনো ৬৪ অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের ২৪টি খালি। তো, কোন কোন সৌখিন ফ্ল্যাট মালিক ফ্ল্যাটের কাঠামো ও মেঝে ভেঙে নিজের পছন্দমত অন্দরসজ্জা করছেন। আগেও হয়েছে। পরে যারা উঠছেন তারাও করছেন। সর্বোচ্চ লেভেলের একটি ফ্ল্যাটের সামপ্রতিক ভাঙচুরের ইট, সুড়কি, টাইলসগুলো বস্তায় জমা করে নিচে নামানো হচ্ছে। কুঁজো হয়ে ভারী বস্তা টানা মানুষগুলোর অমানুষিক কষ্ট ও পরিশ্রম দেখে আতঙ্কে শরীর হিম হয়ে আসে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে যায় পা। কীভাবে সম্ভব! একজন সুস্থ সবল তরুণের পক্ষেও ১১ তলা পর্যন্ত সিঁড়ি ভেঙে একবার উঠা-নামাও খুব কঠিন কাজ। আর এঁরা তিনটি প্রাণী কিনা ৫০ কেজি ওজনের কয়েক ডজন বস্তা মাথায় নিয়ে বারবার উপর নিচ উঠানামা করছেন! আতঙ্কে হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ বহে যাচ্ছে অস্তিত্বজুড়ে! রাস্তায় রিক্সা বা সাইকেল ভ্যান চালকেরা সূর্যের তীব্র দহনের মাঝেও যাত্রী বা মালামাল টানেন। এঁদের পরিশ্রম সহনীয়তা, ক্যালরি ক্ষয়, অপুষ্টি ও গড় আয়ু নিয়ে কোন সংস্থা বা এনজিওর জরিপ রিপোর্ট চোখে পড়েনি। নিজের নমুনা অনুসন্ধানে জেনেছি, বাংলাদেশের মানুষের গড় আযু ৭২/৭৩ বছর হলেও এঁদেরসহ নির্মাণ শ্রমিক, দিন মজুরদের আয়ুর গড় ৪৫ বছরের নিচে। ওঁদের কষ্ট দেখে মন খারাপ করলেও প্রায় সয়ে গেছে সবার-আমারও। কিন্তু এদিনের অভিজ্ঞতা মানবিক অস্তিত্বটাই নাড়িয়ে দেয়। শরীরচর্চা থেমে যায় তাৎক্ষণিক। নিজের সুখের জগতে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের বাদুর পাখা ঝাপ্টাতে থাকে। হায়রে, আমি সর্বোচ্চ ৭ তলা পর্যন্ত সিঁড়ি ভাঙতে পারি। বয়স বিবেচনায় এটা অনেক। আর এই মানুষগুলো আমাদের সুরম্য নিবাসের জঞ্জাল টানতে ৫০ কেজি বস্তা মাথায় নিয়ে বার বার ১১ তলা উঠানামা করছেন! আমার মত ওনাদের শরীরের রক্তও লাল। সামান্য হোঁচট খেলে আমি যেমন ব্যাথা পাই, এঁরাও ঠিক একই ব্যাথা পান। তাহলে কেন এঁরা পৃথিবীতে নরক বাস করবেন, বিপরীতে আমার বিলাসী স্বর্গবাস! কোন পূণ্য বা পাপে এমন বৈষম্য! মাথাপিছু গড় আয় ২২০০ ডলার কার পাতে যাচ্ছে? এত উন্নয়ন, জাতীয় প্রবৃদ্ধিইবা কারা লুটছে? স্বর্গ নরক বা দোযখ বেহেশত লাভ আপেক্ষিক বিষয়। মৃত্যুর পর কে কোথায় যাবে, উপরওয়ালা ছাড়া কেউ জানে না। কিন্তু পৃথিবীতে বেঁচে থেকে কেন কিছু মানুষ স্বর্গসুখ কিনবে, আরেক শ্রেণির মাথায় বাতিল জঞ্জালের বস্তা চাপিয়ে? এটা কেমন বিচার! এমন অমানবিক পৃথিবী বা দেশ কেন? প্রশ্নটি সর্বাঙ্গে বিছুটির জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে!