স্বপ্নকে বিসর্জন দেয়া যাবে না

ড. জান্নাতুন নাঈমা জেবিন | রবিবার , ১৪ মে, ২০২৩ at ৬:৩৫ পূর্বাহ্ণ

ইউএসটিসির বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক মেধাবী জান্নাতুন নাঈমা জেবিন স্বপ্নকে বিসর্জন দেননি। সন্তানের জন্য নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন কিন্তু পিএইচডি অর্জনের হাল ছেড়ে দেননি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ থেকে প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত জেবিন বৃত্তি নিয়ে জাপানে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর জাপানের কানাজাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পান পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের। মাঝখানে জন্ম নেয় তার প্রথম সন্তান। কিন্তু কোভিডের লকডাউন আর চাকুরির কারণে মাত্র কয়েকমাসের বাচ্চাকে ফেলে চলে আসতে হয় স্বামীকে। শুরু হয় জেবিনের নতুন সংগ্রাম। তিনি বলেন, মা হবার পর আমি যখন আবার কাজে ফিরি আমার বাচ্চার বয়স মাত্র তিন মাস। বাচ্চাকে বাসায় দেখাশোনা করার কেউ ছিল না তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডে কেয়ারে দিতে হয়। শুরুর দিকে কাজে মনোযোগ দিতে পারতাম না, মনে হতো বাচ্চা ঠিকমতো খাচ্ছে কিনা, হয়ত না খেয়ে আছে একটু পরপর ফোন চেক করতাম ডে কেয়ার থেকে ফোন দিয়েছে কিনা, ঘড়ি দেখতাম একটু পরপর কখন বাসায় যাবার সময় হবে নিজেকে অপরাধী মনে হতো, মনে হতো আমি কেমন মা। আমি পিএইচডির তৃতীয় বছর শুরু করি তখন। আমি সময় বাড়াতে চাইনি কারণ তাড়াতাড়ি শেষ হলে আমার বাচ্চা তাড়াতাড়ি পুরো পরিবার এক সাথে পাবে। ধীরে ধীরে পরিবর্তন আমরা মামেয়ে দুজনেই মেনে নিতে শিখি। আমার মেয়ের বয়স যখন ছয় মাস একদিন ডে কেয়ার থেকে ফোন আসলো আমার মেয়ের জ্বর, ওকে যেন নিয়ে বাসায় নিয়ে আসি। জ্বর খুব বেশি হওয়ায় মেয়ে কিছু খেতে পারে না তাই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে টেস্ট করে দেখি আর এস ভাইরাস ইনফেকশন হয়েছে। একদিন পর অবস্থার উন্নতি না হলে আবার ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার সবকিছু চেক করে সাজেস্ট করে যেন আমি হসপিটালাইজড করি তাকে। হসপিটালের বেডে রাতে ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি সেদিন আমার চাওয়াপাওয়ার সমীকরণ করছিলাম। ভাবছিলাম আমি যদি পিএইচডি না করতাম হয়তো মেয়েকে ডে কেয়ারে দিতে হতো না, হাসপাতালে আমার মেয়ের মুখে ভেন্টিলেটর লাগিয়ে রাখতে হতো না। এরপর এমন তীব্র জ্বর আরো অনেকবার এসেছে, মাঝরাতে কখনো প্রতিবেশীর, কখনো বন্ধুর ঘুম ভেঙে কখনো নিজে ট্যাঙি ডেকে ইমারজেন্সিতে নিয়ে গেছি। বাচ্চার ব্লাড টেস্টের জন্য যখন ব্লাড নিত, তখন সে চিৎকার করে কাঁদত, আমি ওর সামনে অসহায়ত্ব বোধ করতাম, কাঁদতে চাইতাম কিন্তু ওর সামনে পারতাম না। কোনো পরিস্থিতিতেই যাতে নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন না দেয়, যেন সে শিখে লক্ষ্য অর্জনে রাস্তা সব সময় সবার জন্য সহজ হয় না। কিন্তু অটল থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। সবচেয়ে বড় হল সে যেন কখনো মনে না করে মা হলে মেয়েরা পিছিয়ে যায়। সে যেন বুঝে মাতৃত্ব আমাদের জীবনের অংশ, কোনো বোঝা নয়। আমার ল্যাবে কাজের প্রেসারের মাঝেও আমি সব সময় চেষ্টা করছিলাম ল্যাব থেকে ফিরে এসে আমার সন্তান যেন সময় পায়। আমি নিউট্রিশন ভ্যালু দেখে ওর জন্য রান্না করতাম প্ল্যান করে প্রতিদিন সকালে আর বিকেলে পার্কে বেড়াতে যেতাম নিয়ে যেতাম। শিক্ষকরা জিজ্ঞেস করতেন আমি কিভাবে একা একা বাচ্চা নিয়ে পড়াশোনা এবং সংসারের সবকিছু সামাল দিই। দিনশেষে পারসুট অফ হ্যাপিনেস মুভির মত অনুভব করেছি, স্ট্রাগল শেষে যে অর্জন, সন্তানকে দুধে ভাতে রাখার যে সক্ষমতা, এই ছোট অনুভুতিটাই আমার হ্যাপিনেস।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিজের যোগ্যতায় এগিয়ে যেতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধসংগ্রামটা আমার একার