সারা বিশ্ব অবগত যে, শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান করতে গিয়ে বাংলাদেশ এক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর আগমন তাদের নিরাপত্তা বিধান ও পরিচর্যার জন্য বিশাল ধরনের কর্মযজ্ঞের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ঘনবসতি, সম্পদের স্বল্পতা, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে দারিদ্র্যের মাত্রা ও পরিকাঠামোগত স্বল্পতা এবং একই সঙ্গে শরণার্থী মোকাবিলার প্রয়োজনীয় আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অনুপস্থিতি বিষয়টিকে আরও জটিল করেছে। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের উচ্চতম পর্যায় থেকে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘভুক্ত প্রতিষ্ঠানকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে বেশ কিছু সেক্টর চিহ্নিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে এই চাপ মোকাবিলায় দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছে, যার সাড়া ইতিমধ্যে মিলছে।
শরণার্থী সমস্যা, বিশ্বজুড়ে একটি জটিল সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, সমগ্র বিশ্বে প্রায় ৪৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন শরণার্থী নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রহীন ও বিতাড়িত একটি জীবন যাপন করে আসছে। এখানে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হলো, বিশ্বজুড়ে নানাভাবে বাস্তুচ্যুত শরণার্থীদের আশ্রয় হয়েছে তার দেশের আশপাশে থাকা নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। এই প্রবণতার কারণে শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া নিম্ন আয়ের দেশগুলো নিজেদের উন্নয়ন সমস্যা মোকাবিলার পাশাপাশি শরণার্থীদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় নানাভাবে হিমশিম খাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, এমন একটি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের ষষ্ঠ বিমসটেকের বৈঠকের সময় মিয়ানমার থেকে একটি ইতিবাচক সাড়া আমরা দেখতে পাই, যা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য একটি আশার সঞ্চার করেছে। এই আলোচনায় মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ থান শিউ প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন, যাদের মিয়ানমার নিজ দেশের বাসিন্দা বলে, তারা যাচাই করে নিশ্চিত হতে পেরেছে। তিনি আরও বলেন যে দ্রুততার সঙ্গে বাকি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভেরিফিকেশন করা হবে। তাঁরা বলেন, বিগত সরকারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যা মোকাবিলায়, বিশেষ করে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন ব্যর্থতার মধ্যে মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি–সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেন্টেটিভের প্রতিনিধির যৌথ বিবৃতি আমাদের আশাবাদী করে তোলে। এর পেছনে হয়তো গত মাসে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশে ভ্রমণ এবং আমাদের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ইফতার ও সভার একটি ভূমিকা পালন করে থাকতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, এই ইতিবাচক প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে আমরা কতটা নিশ্চিত হতে পারব যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অন্তত এই ১ লাখ ৮০ হাজার তাদের নিজ দেশে ফেরত যেতে পারবে। সেই বিষয়গুলো মাথায় রেখে বাংলাদেশ সরকারকে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে।
তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম খুব বেশি আশাবাদী নন। তিনি পত্রিকান্তরে বলেছেন, ‘বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস যতই চেষ্টা করুন না কেন, আমি মনে করি তিনি পাঁচজন রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবাসন করাতে পারবেন না। এরই মধ্যে সরকারের মেয়াদও শেষের দিকে। এছাড়া গত বছরই উলটো আরও এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অন্যদিকে আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্য সাময়িকভাবে দখল করলেও বর্তমানে জান্তা সরকারের সেনাবাহিনী নিজেদের গোষ্ঠীগুলো সামলে আবারও আরাকান আর্মির ওপর আক্রমণ শুরু করেছে। এই পরিস্থিতি আরাকান আর্মি টিকিয়ে রাখতে পারবে না।’ তিনি বলেন, ‘ড. ইউনূস যদি জাতিসংঘ মহাসচিবকে বাংলাদেশে আনার পরিবর্তে মিয়ানমারে পাঠাতে পারতেন, তাহলে অন্তত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারকে রাজি করানোর চেষ্টা হতো। কিন্তু সেটাও বাস্তবসম্মত নয়। কারণ গাজায় গণহত্যা চলছে, সেখানে জাতিসংঘের ভূমিকাই বিশ্ববাসীর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। জাতিসংঘ কথায় আজ আর কেউ আস্থা রাখে না।’
মোট কথা, রোহিঙ্গা সংকটের চূড়ান্ত সমাধান হলো মর্যাদাপূর্ণ ও স্থায়িত্বশীল প্রত্যাবাসন এবং তা নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর তৎপরতা আরও বহুগুণে বৃদ্ধি করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার মূল দায়িত্ব মিয়ানমারের। বাংলাদেশ তাদেরকে মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এখন শুধু মানবিক সহায়তা দিলেই হবে না, আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে মায়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করতে হবে।