চট্টগ্রাম থেকে সার পরিবহনে অন্তত ১০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে সরকারকে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে পুঁজি করে বিসিআইসির তালিকাভুক্ত মাত্র চারটি পরিবহন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বাড়তি এই টাকা আদায় করছে। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে টনপ্রতি একশ টাকা খরচ না বাড়লেও সড়কপথে ১০ শতাংশ এবং নদীপথে ১৭ শতাংশ বাড়তি ভাড়া আদায় করায় টনপ্রতি গড়ে তিনশ টাকারও বেশি বাড়তি অর্থ সরকারকে গুণতে হচ্ছে। অবশ্য জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর চট্টগ্রাম থেকে সার পরিবহনে যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছিল ভাড়া বাড়িয়ে দেয়ার পর তাতে ব্যাপক গতিশীলতা তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে দিনে-রাতে সমানে সার পরিবহন চলছে।
সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামের দুইটি সার কারখানা থেকে দেশের নানা অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে সার পরিবহন করা হয়। এরমধ্যে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) সারের পাশাপাশি সরকার বহুজাতিক সার কারখানা কাফকো থেকেও আন্তর্জাতিক বাজার দরে সার কিনে নেয়। উপরোক্ত দুইটি সার কারখানায় উৎপাদিত হাজার হাজার টন সার পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন গুদামে। ওখান থেকে ডিলারদের মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়। বিসিআইসির নিয়ন্ত্রাণাধীন গুদামগুলোতে সংস্থার তালিকাভুক্ত পরিবহন ঠিকাদারেরাই সার পরিবহন করে। এরমধ্যে মেসার্স দেশ ট্রেডিং নামের পরিবহন ঠিকাদার টেপাখোলা গুদামে ২০ হাজার টন, বরিশালে ৩০ হাজার টন এবং ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে ২৫ হাজার টন মিলে সর্বমোট ৭৫ হাজার টন সার পরিবহন করে। ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড নামের পরিবহন ঠিকাদার নাটোরে ১৫ হাজার টন এবং শেরপুরে ১৫ হাজার টন মিলে মোট ৩০ হাজার টন সার পরিবহন করছে। মেসার্স রহুল আমীন ভূঁইয়া নামের অপর একটি পরিবহন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৫ হাজার টন, পঞ্চগড়ে ১৫ হাজার টন এবং যশোরে ৩০ হাজার টন মিলে সর্বমোট ৬০ হাজার টন সার পরিবহন করছে। গ্রামসিকো লিমিটেড নামের অপর একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শিরোমনিতে ২৫ হাজার টন এবং শম্ভুগঞ্জে ১৫ হাজার টন মিলে সর্বমোট ৪০ হাজার টন সার পরিবহন করছে।
চট্টগ্রাম থেকে সংশ্লিষ্ট গুদামগুলোতে সার পরিবহনের ভাড়ার হার বিভিন্ন। এরমধ্যে টেপাখোলায় প্রতিটন সার পরিবহনের ভাড়া ২১৯৭ টাকা, বরিশালে ১৬৭৪ টাকা, কালীগঞ্জে ২৪৫৮ টাকা, নাটোরে ২৯১০ টাকা, শেরপুরে ২৬৪০ টাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৯৮৫ টাকা, পঞ্চগড়ে ৩১০৫ টাকা, যশোরে ২৩৭৬ টাকা, শিরোমনিতে ২১৪৪ টাকা এবং শম্ভুগঞ্জে ২৫২২ ভাড়ার হার নির্ধারিত ছিল। বিসিআইসির সাথে পরিবহন ঠিকাদারদের সম্পাদিত চুক্তিতে উপরোক্ত হারে সার পরিবহনের কথা। কিন্তু জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার পর পরিবহন ঠিকাদারেরা উপরোক্ত ভাড়ায় দেশব্যাপী সার পরিবহন অঘোষিতভাবে প্রায় বন্ধ করে দেয়। কৃষির ভর মৌসুমে বিভিন্ন অঞ্চলে সারের অভাব প্রকট হয়ে উঠে।
পরবর্তীতে বিসিআইসি বাধ্য হয়ে পরিবহন ঠিকাদারদের সাথে আলোচনা করে সড়কপথে ১০ শতাংশ এবং নৌপথে ১৭ শতাংশ বাড়তি ভাড়া কার্যকর করে। আর বাড়তি ভাড়া পাওয়ার পর চট্টগ্রাম থেকে দেশব্যাপী সার পরিবহনে নতুন গতি আসে। তবে এক্ষেত্রে বিসিআইসিকে চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ২ লাখ ৫ হাজার টন সার পরিবহনে বাড়তি খরচ করতে হবে প্রায় ১০ কোটি টাকা। পঞ্চাশ কোটি টাকায় যে সার পরিবাহিত হতো, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে তা পরিবহন করতে ব্যয় হচ্ছে অন্তত ৬০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, পরিবহন ঠিকাদারেরা জিম্মি করে বাড়তি টাকা আদায় করেছে। চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যে সার পরিবাহিত হয় তাতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে টনপ্রতি একশ টাকার বেশি খরচ হয় না। অথচ সড়ক পথে টন প্রতি গড়ে দুইশ টাকারও বেশি এবং নৌপথে প্রায় চারশ টাকা বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বা পঞ্চগড়ে আগে যে ভাড়া ছিল তার সাথে সড়কপথে টনপ্রতি ৩শ টাকা এবং নৌপথে ৫শ টাকা ভাড়া বেড়ে গেছে। এভাবে প্রতিটি রুটেই বাড়তি ভাড়া গুণতে হচ্ছে বিসিআইসিকে।
সিইউএফএল-এর সংশ্লিষ্ট একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, কৃষির ভর মৌসুমে সরকার টাকার চেয়ে কৃষকের হাতে সার পৌঁছানোকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এতে করে পরিবহন ঠিকাদারদের দাবি খুব সহজে মেনে নেয়া হয়েছে। এতে বিসিআইসি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দেশের কৃষি সেক্টর লাভবান হচ্ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপরোক্ত একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি এমন নয়। জ্বালানি তেলের মূল্য যেভাবে বেড়েছে সেভাবে ভাড়া বাড়েনি। অস্বাভাবিক হারে তেলের দাম বেড়েছে। এতে আমাদের কী করার আছে! তেল ছাড়াতো আর গাড়ি বা জাহাজ চলে না। সুষ্ঠুভাবে সার পরিবাহিত হচ্ছে এটিই বড় ব্যাপার বলেও তিনি উল্লেখ করেন।