স্ট্রোকের পর ফিজিওথেরাপি কেন অপরিহার্য

মো: আইনুর নিশাদ রাজিব | মঙ্গলবার , ২৮ অক্টোবর, ২০২৫ at ৮:১৭ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বে দ্বিতীয় প্রধান মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক। অসংক্রামক ব্যাধির মধ্যে মৃত্যুর দিক থেকে হৃদরোগের পরেই স্ট্রোকের অবস্থান এবং শারীরিক অক্ষমতার জন্য স্ট্রোক সবচেয়ে বেশি দায়ী।

প্রতি বছরের ন্যায় এবারও আমাদের দেশে স্ট্রোক দিবসটি নানা কর্মসূচিতে পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, Every Minute Counts অর্থাৎ প্রতিটি মুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ। স্ট্রোক হওয়ার পর এক মুহূর্তও নষ্ট করা উচিত নয়। যত দ্রুত স্ট্রোকের লক্ষ্মণগুলো চেনা যাবে এবং রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যাবে, মস্তিষ্কের ক্ষতি তত কমানো সম্ভব হবে। চিকিৎসা শুরু করতে এক মিনিট দেরি হওয়া মানেই মস্তিষ্কের বহু কোষ নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং রোগীর স্থায়ী ক্ষতির ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া। তাই স্ট্রোকের লক্ষ্মণ দেখলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া অপরিহার্য।

স্ট্রোকের লক্ষ্মণ দ্রুত চিনতে ‘BE FAST’ পদ্ধতিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি স্ট্রোক হলে রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নেওয়ার বার্তা দেয়।

BE FAST এর অর্থ:

B (Balance): হঠাৎ ভারসাম্য হারানো।

E (Eyes): দৃষ্টিশক্তির সমস্যা।

F (Face): মুখের একদিক ঝুলে যাওয়া।

A (Arm): হাতের দুর্বলতা।

S (Speech): কথা জড়িয়ে যাওয়া।

T (Time): দেরি না করে দ্রুত ৯৯৯ (বা জরুরি নম্বর)-এ কল করা।

এই লক্ষ্মণগুলির মধ্যে যেকোনো একটি দেখা গেলেই সময় নষ্ট না করে জরুরি চিকিৎসা শুরু করা অত্যন্ত জরুরি। এতে মস্তিষ্কের ক্ষতি কমানো সম্ভব হয়।

স্ট্রোক কী?

মস্তিষ্কের নিজস্ব রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হলে মস্তিষ্কে কিছু স্নায়ুকোষ নষ্ট হয়ে যেতে পারে একেই স্ট্রোক বলে। এর ফলে মস্তিষ্ক প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয় এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে মস্তিষ্কের কোষগুলি মারা যেতে শুরু করে। মস্তিষ্কের যে অংশে স্ট্রোক হয়, সেই অংশের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।

স্ট্রোক মূলত দুই প্রকার। প্রথমটি হল ইস্কেমিক স্ট্রোক যা রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধার কারণে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে এটি হয়। এটি সবচেয়ে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। আর অন্যটি হল হেমোরেজিক স্ট্রোক যা মস্তিষ্কের রক্তনালী ফেটে গিয়ে রক্তপাত হলে হয়ে থাকে।

স্ট্রোক একটি মেডিকেল ইমার্জেন্সি। দ্রুত চিকিৎসা শুরু না হলে এটি স্থায়ী অক্ষমতা বা এমনকি মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

স্ট্রোকপরবর্তী সমস্যা

মস্তিষ্কের কোথায় কতটুকু আক্রান্ত হয়েছে, তার ওপর নির্ভর করে স্ট্রোকের তীব্রতা, লক্ষ্মণ এবং সমস্যাগুলো প্রকাশ পায়।

যেমন :

শরীরের এক পাশ অথবা অনেক সময় দুই পাশ অবশ হয়ে যেতে পারে। মাংসপেশির টান বা স্থিতিস্থাপকতা প্রাথমিক পর্যায়ে কমে যেতে পারে, পরে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। হাতপায়ের নড়াচড়া আংশিক বা সম্পূর্ণ কমে যেতে পারে।

হাঁটাচলা, উঠাবসা, বিছানায় নড়াচড়া কমে যেতে পারে। এমনকি প্রস্রাবপায়খানা নিয়ন্ত্রণজনিত সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

অনেক সময় নড়াচড়া কমে যাওয়ার ফলে শুয়ে থাকার জন্য চাপজনিত ঘা দেখা দিতে পারে। কাঁধের জয়েন্ট সরে যেতে পারে। পুশার সিনড্রোম দেখা দিতে পারে। হেমিস্পার্শিয়াল নেগলেক্ট সিনড্রোম দেখা যায়।

মস্তিষ্কের জটিল ও বিষ্ময়কর সক্ষমতাসমুহ:

মস্তিষ্ক মানুষের শরীরের সবচেয়ে জটিল ও বিস্ময়কর অঙ্গ। মস্তিষ্কের কিছু ক্ষমতা রয়েছে স্ট্রোকের পরে নিজেকে আবার আগের মতো সক্ষম করে তোলার। যেমনঃ

ইশকেমিক পিনামব্রা (Ischemic penumbra) হলো মস্তিষ্কের সেই এলাকা যা স্ট্রোকের সময় রক্ত সরবরাহ কমে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে পুরোপুরি মারা যায় না। এটি মূল ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার (Infarct Core) চারপাশের একটি অঞ্চল।

এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাস করা হতো, মস্তিষ্কের গঠন একবার স্থির হয়ে গেলে তা আর বদলায় না। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান এই ধারণা পাল্টে দিয়েছে। মস্তিষ্কের অসাধারণ একটি ক্ষমতার নাম নিউরোপ্লাস্টিসিটি (Neuroplasticity)। এটি হলো এমন একটি ক্ষমতা যার মাধ্যমে মস্তিষ্ক তার কাঠামো, কার্যকারিতা এবং সংযোগকে পুনর্গঠিত করতে পারে। অর্থাৎ, আপনার মস্তিষ্ক সারা জীবন ধরে এর মাধ্যমে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। মস্তিষ্ক হলো আমাদের চিন্তা, অনুভব, ও আচরণের নিয়ন্ত্রক কেন্দ্র যা ৮৬ বিলিয়ন নিউরন ও অসংখ্য সিন্যাপসের মাধ্যমে মুহূর্তে ট্রিলিয়ন বার তথ্য প্রক্রিয়াজাত করতে পারে।

মস্তিষ্কের এই বিশেষ ক্ষমতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকগণ স্ট্রোক রোগীকে পুনরায় আগের জীবনে ফিরে যেতে সাহায্য করতে পারে।

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা:

একজন রোগীর স্ট্রোকপরবর্তী শারীরিক সমস্যা দূর করে স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে সঠিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা প্রয়োজন। স্ট্রোকের পর যত দ্রুত রোগীর ফিজিওথেরাপি শুরু করা যাবে, রোগীর কার্যক্ষমতা ফিরে আসার সম্ভাবনাও তত বেশি। বর্তমানে গবেষণালব্ধ এবং বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসায় প্রথমে রোগীর রোগ বর্ণনা, শারীরিক পরীক্ষাসহ, বিভিন্ন রেডিওলজিক্যাল ও প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে কী ধরনের স্ট্রোক, কী ধরনের শারীরিক সমস্যা আছে তা নির্ণয় করা হয়। এরপর রোগীর সমস্যা অনুযায়ী স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি এভিডেন্স বেইজড ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার পরিকল্পনা করা হয়। এর মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করা, সঠিক পজিশনিং ও মাংসপেশির স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তীতে মাংসপেশির স্বাভাবিক টান ফিরিয়ে আনা, হাত ও পায়ের শক্তি ফিরিয়ে আনা, শরীরের স্বাভাবিক অ্যালাইনমেন্ট ফিরিয়ে আনা, শরীরের বিভিন্ন জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধির নড়াচড়া করার ক্ষমতা ফিরিয়ে আনা, ব্যালেন্স ও কোঅর্ডিনেশন উন্নত করা, স্বাভাবিক হাঁটার ক্ষমতা ফিরিয়ে আনা এবং সর্বোপরি রোগীর কর্মদক্ষতা বাড়ানো হয় ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের গবেষণালব্ধ পদ্ধতি বা ধারণা ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে এনডিটি অ্যাপ্রোচ বা নিউরো ডেভেলপমেন্টাল থেরাপি, কারেন্ট শেফার্ড অ্যাপ্রোচ, CIMT, PNF, মোটর লার্নিং স্ট্র্যাটেজি, রুট অ্যাপ্রোচ জনপ্রিয়।

স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা, ফিজিওথেরাপি ও সুস্থ হওয়ার ক্ষেত্রে বয়স গুরুত্বপূর্ণ। যাদের বয়স একটু কম, তাদের উন্নতি অনেক বেশি দেখা যায়। ৫০ বছরের বেশি বয়স যাদের, তাদের সুস্থস্বাভাবিক হতে সময় লাগে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, বয়সের কারণে পেশির কোষ কমে যায়, ক্ষয়জনিত বিভিন্ন সমস্যার ও বিভিন্ন রোগের কারণে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে সময় লাগে, পুরোপুরি সুস্থতাও সম্ভব হয় না অনেক সময়।

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার অবহেলায় জটিলতাসমুহ:

যেকোনো বয়সেই স্ট্রোক হোক না কেন, ফিজিওথেরাপি নেওয়া জরুরি। তা না হলে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে পরবর্তীতে। যেমন: রোগীর হাত ও পা বেঁকে যেতে পারে, জয়েন্ট স্টিভনেস বা অস্থিসন্ধিগুলোর স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হতে পারে, শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে, রোগীর স্বাভাবিক চলাফেরা এবং হাঁটাচলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারেন, কর্মদক্ষতা আংশিক বা সম্পূর্ণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে বা হ্রাস পেতে পারে। পরনির্ভরশীল জীবনযাপন করতে হতে পারে।

সতর্কতা:

সতর্ক থাকতে হবে যে, আমাদের দেশে বিভিন্ন স্থানে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা দেওয়া হয়। কিছু কিছু স্ট্রোকের রোগীদের শুধুমাত্র গড়পড়তাা হিট, ভাইব্রেশন কিংবা বিভিন্ন রকমের তেল মালিশসহ বিভিন্ন কুসংস্কারের মাধ্যমে সুস্থ করার চেষ্টা করা হয়। এসব ভুল বা অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা হিতে বিপরীত হতে পারে কখনো কখনো তা স্থায়ী পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাই অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং সে অনুযায়ী চলার চেষ্টা করুন।

লেখক: ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ইনচার্জ, ফিজিওথেরাপি বিভাগ সিআরপি চট্টগ্রাম .কে.খান কেন্দ্র।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅধীনস্থের প্রতি ব্যবহার হোক ন্যায় সঙ্গত
পরবর্তী নিবন্ধস্থবির শিল্প বিনিয়োগ : চ্যালেঞ্জের মুখে অর্থনীতি