স্ট্যাচু অব লিবার্টি : সভ্যতার নান্দনিক স্মারক

শঙ্কর প্রসাদ দে | শুক্রবার , ১৬ আগস্ট, ২০২৪ at ১০:০৮ পূর্বাহ্ণ

১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ফুটফুটে শীতার্ত সকাল। ফ্লুশিং মেইন স্টেশন থেকে মেট্রোতে চড়ে ব্যাটারী পার্ক অত:পর ফেরীতে করে কৃত্রিম লির্বাটি আইল্যাণ্ড। ছবি, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, বইয়ের পাতা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবিটি শতবার দেখেও স্বচক্ষে দেখার ক্ষুধা মেটেনি। মামুন বললো, কাছে আছে এবং লিবার্টিতে মোটামুটি পুরোদিন কেটে যাবে। সন্ধ্যায় অফিস শেষে হোটেল লবি থেকে তোমাদের পিক করবো। ১০ টার দিকে আইল্যাণ্ডে নেমেই শুরু হল স্বপ্ন মেলানোর পালা। আইল্যাণ্ড থেকে নিউইয়র্ক সিটির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, হয়তো’বা এখানে একখণ্ড ভূমি ছিল। অত্যাধুনিক স্থাপত্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে জড়ো করা হয়েছে সিমেন্টের কংক্রিট, সিমেন্টের ফোল্ডার, সাইজ করা পাথর খণ্ড দিয়ে ১২ একরের কৃত্রিম দ্বীপটি সৃষ্টি করা হয়েছে। অতঃপর শুরু হল ৯২.৯৯ মিটার উচ্চতার শ্রেষ্ঠতম ভাস্কর্যের নির্মাণ পর্ব। এটি জাতীয় উদ্যান সেবা কর্তৃপক্ষ আজো দেখভাল করে চলেছেন।

ফরাসী রেলওয়ের উচ্চাভিলাষী প্রকৌশলী গুস্তাভ আইফেল ভাঙ্গা লোহার ব্রীজের খণ্ডাংশ দিয়ে তৈরী করেন আইফেল টাওয়ার। ১৮৮৯ সালে নির্মাণ শেষ হওয়ার পর তৎকালীন বিশ্বখ্যাত মার্কিন বিজ্ঞানি টমাস এডিসন পরিদর্শন করে স্তম্ভিত হয়ে যান। ফ্লান্স দখলে নেয়ার পর হিটলার আইফেল টাওয়ারে উঠতে চেয়েছিলেন। প্যারিস শহর ত্যাগের আগে প্রকৌশলীরা লিফটের বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ায় ভগ্ন মনোরথে হিটলার দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। আমি সন্ধ্যার দিকে আইফেল টাওয়ারের নীচে পৌঁছেছিলাম। টাওয়ারের গ্রাউণ্ড বাউণ্ডারীর সংস্কার কাজ চলছিল। ইচ্ছে ছিল একেবারে উপরে উঠবো আর মাঝবরাবর রেস্টুরেন্ট থেকে বার্গার খেতে খেতে রাতের প্যারিস দেখবো। পারলাম না রুনুর জন্য। রুনুর এককথা লোহার স্ট্রাকচার দেখলাম তো, অত্র উপরে উঠার কাম নাই। উঠা হল না, ধারণা করা হয় আইফেল টাওয়ার দেখে উচ্চাভিলাষী মার্কিনীদের মনে লোহার টাওয়ারের পরিবর্তে একটি শৈল্পিক ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন উদিত হয়। সময়টাও ছিল অস্থির। দাসপ্রথা ও গৃহযুদ্ধকে পেছনে ফেলে আমেরিকা ঘুরে দাড়াতে চাইছে। রাজনীতিবিদ্‌দের একটা স্বপ্ন মার্কিন মুল্লুকে গড়ে তুলতে হবে বহু ভাষা, বহু বর্ণ, বহু ধর্ম নিয়ে একক জাতিসত্তা। তবে সর্বাগ্রে এর একটি প্রতীক চাই।

মার্কিন রাজনীতিবিদ লাবলয়ে তাঁর ফরাসী বন্ধু সৌখিন ভাস্কর ও আইনের অধ্যাপক বার্থন্ডিকে বললেন, চলো মার্কিনফরাসী যৌথ শৈল্পিক ভাবনাকে একত্রিত করে একটি স্মারক নির্মাণ করা যাক। যেই ভাবনা সেই কাজ। বার্থন্ডি ভাস্কর্যের মাথা এবং ডান হাতটি প্রথমে সরবরাহ করলেন। নন্দিত লেখিকা ইসাবেলা বোরার চেহারাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে লিবার্টীর মুখশ্রীতে। এগুলো জনগণের মতামতের জন্য প্রদর্শিত ছিল মেডিসন স্কয়ার পার্কে। ১৮৭৬ থেকে ১৮৮২ পর্যন্ত শুরু হল টাকা তোলার কাজ, নেতৃত্বে এলেন প্রকাশক জোসেফ পুলিৎজার। দ্রুত ১ ডলার ২ ডলার করে দেয়া অনুদান অতিক্রম করলো মিলিয়নের অঙ্ক। এবার আসলো ভাস্কর্য্যের বাকী অংশ গুলো। চাঁদা তোলার দলে দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছেন বহু উৎসাহীর মতো যুবক রুজভেল্ট। এই রুজভেল্ট’ই পরবর্তীকালে হলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।

১৮৬৫ সালে দাসপ্রথা বিলোপ ডিক্রীতে দস্তখত করার কয়েক দিনের মধ্যে আব্রাহাম লিংকনকে থিয়েটার হলে গুলি করে হত্যা করেন অভিনেতা জন উইকিলিস। প্রায় পাঁচ বছরের জন্য বিশাল দেশটি নিমজ্জিত হয় গৃহযুদ্ধে। বিরোধটা ছিল নিতান্ত তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক। ইউনিয়ন থেকে ইউনাইটেড স্টেট অব আমেরিকা। শাব্দিক অর্থ হলো অর্ধশত রাজ্যের সকল অধিবাসীর পরিচয় হল আমরা আমেরিকান। পক্ষান্তরে ১১টি রাজ্য বলল আমরা এক আমেরিকায় বিশ্বাসী নই। প্রত্যেক রাজ্য নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য পরিচয় ও সংস্কৃতি নিয়ে আমরা কনফেডারেশনের ঘোষণা দিলাম। অর্থাৎ কনফেডারেশন বনাম ফেডারেলিস্টদের এই লড়াই হলো আমেরিকান গৃহযুদ্ধ। ১৮৬৫ সালে গৃহযুদ্ধের সমাপ্তিতে লাবলয়ের মতো রাজনীতিকরা জাতীয় ঐক্যের পথ খুঁজছিলেন। এই ঐক্যের স্মারক হল “স্ট্যাচু অব লিবার্টি” বা স্বাধীনতার প্রতীক ভাস্কর্য।

ভাস্কর্যের স্থাপত্য কৌশল নিও ক্লাসিকাল। রোমান মিথ অনুযায়ী দেবী ‘লিবার্টাস’ স্বাধীনতার প্রতীক। দাসদের কাছে ‘লিবার্টি’ হলো তাদের সংগ্রামের দেবী, মুক্তির দেবী। এক সময় অনেক রাজ্যের মুদ্রায় লিবার্টি দেবীর মুর্তি ব্যবহৃত হয়েছে। দাসরা মুক্তি পেলে যে টুপি দিয়ে চিহ্নিত করা হতো সেই টুপিটিই শোভা পাচ্ছে লিবার্টির মাথায় মুকুট হিসেবে। সম্পূর্ণ তামায় নির্মিত পুরো ভাস্কর্যের মুকুটে সাতটি অরিওল বা রশ্মি সাতটি মহাদেশ সাতটি মহাসাগর এর প্রতীকী চিহ্ন। বিশালত্ব বিবেচনায় নিলে ক্ল্যাসিকাল ভিত্তির উপর নিও ক্ল্যাসিকাল স্থাপত্য। ডান হাতে মশাল জ্ঞানের প্রতিক। জ্ঞানের এই মশাল দিয়ে লিবার্টি গোটা পৃথিবীকে বলছে, এসো বিশ্ববাসী আমরা জ্ঞান, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের সাধনায় নিমগ্ন হই। মূর্তির পায়ের নীচকার ছেড়া শেকল দেখলে পর্যটক মাত্রই বুঝতে পারেন, দাসত্বের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে জাতিসত্তা হিসেবে আমেরিকার দুরন্ত অগ্রযাত্রা। বাম হাতের পামলেট বা ট্যাবলেটের মতো ডিসপ্লেটিকে নীচ থেকে মনে হয় বই। আসলে ট্যাবলেটটিতে রোমান হরফে লেখা আছে আমেরিকার স্বাধীনতা অর্জনের তারিখ ৪ জুলাই ১৭৭৬।

পড়ন্ত বিকেলে পেছনের নিউইয়র্ক সিটি দিয়ে গা ছুঁয়ে যাওয়া আটলান্টিকের শৈত্যপ্রবাহ জানান দিচ্ছিলো মার্কিন মুলুকের বেড়ে ওঠার দ্রুততম ইতিহাস। একেবারে শীর্ষ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পার্থিব অপার শান্তি অনুভব করলাম। এটি ক্ষুদ্র মানব জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি। ভাস্কর্যের সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় শিল্পপতি ইউগেন সিক্রেটানকে স্মরণ না করে উপায় আছে? ভদ্রলোক বহন করেছিলেন বিশাল এই ভাস্কর্য তৈরীর সমস্ত ব্যয়ভার।

লেখক: কলামিস্ট; আইনজীবী, আপীল বিভাগ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ সাহাবী ‘আশারায়ে মুবাশশারাহ’
পরবর্তী নিবন্ধবান্দরবানে ঝিরি থেকে গলিত লাশ উদ্ধার