বিশ্বে প্রতিনিয়ত জনপ্রিয়তা বাড়ছে এলপিজির (লিকুফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস)। বেশ কয়েক বছর ধরে রান্নার জ্বালানি হিসেবে বোতলজাত এলপি গ্যাস খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। হালসময়ে যানবাহনের জ্বালানি হিসেবেও এটি জনপ্রিয় হচ্ছে।ফলে দিন দিন চাহিদা বাড়ছে এ তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম জ্বালানির। তবে ২০১৭ সালের ‘এলপি গ্যাস অপারেশনাল লাইসেন্সিং নীতিমালায় স্টোরেজ ক্যাপাসিটি ন্যূনতম ৫ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত করার শর্তে নতুন করে বিপাকে পড়ছেন পুরোনো অপারেটররা। যারা ২০১৭ সালে নীতিমালা হওয়ার আগেই এ খাতে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমান নীতিমালা স্টোরেজ সংক্রান্ত শর্ত বাতিল না হলে কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে এ খাতের ব্যাংক বিনিয়োগও হুমকিতে পড়বে।
সূত্রে জানা যায়, ২০০০ সালের পর থেকে দেশে বোতলজাত এলপি গ্যাসের ব্যবহার শুরু হয়। সময়ের ব্যবধানে এ খাতে বিনিয়োগ নিয়ে আসেন নতুন নতুন উদ্যোক্তারা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০১২ সালে সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানি মিলে মোট এক লাখ টন এলপিজি সরবরাহ করতো। ২০১৫ সালে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু বর্তমানে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বছরে প্রায় ১০ লাখ টন এলপিজি আমদানি করছে। যা দেশের মোট চাহিদার ৯৮ শতাংশ। বাকি ২ শতাংশ দেশে উৎপন্ন হয়। তম্মধ্যে সরকারি এলপিজিএল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ২০ হাজার টন বোতলজাত এলপি গ্যাস বাজারে সরবরাহ করেছে। বর্তমানে ৫৭টি অপারেটর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে লাইসেন্স নিলেও ২৯টি অপারেটর বাজারে তাদের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করেছে।
বর্তমানে বাজারে এলপিজিতে বিনিয়োগকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামে রয়েছে সুপার গ্যাস, বিএম এনার্জি, প্রিমিয়ার এলপি, বিন হাবিব, ইউনিভার্সেল, ইউনিটেক্স, পদ্মা রয়েছে। তাছাড়া দেশে বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, ওরিয়ন, এনার্জিপ্যাক, নাভানা, ফ্রেশ, জেএমআই, পেট্রোম্যাক্স, সেনা, ওমেরা, পেট্রোগ্যাসের মতো বড় প্রতিষ্ঠান এলপি ব্যবসায় যুক্ত রয়েছে। পুরনোদের মধ্যে পদ্মা, বিন হাবিব, ইউনিভার্সেল, হাজী নজীর, এইচএম রহমান, নেওয়াজ (অর্কিড এনার্জি)ও এলপিজি ব্যবসায়ে রয়েছেন।
জানা যায়, ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি “এলপি গ্যাস অপারেশনাল লাইসেন্সিং নীতিমালা, ২০১৭” গ্যাজেট আকারে প্রকাশিত হয়। ওই নীতিমালার ২.৪ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, “এ নীতিমালা প্রকাশের পূর্ব হতে এলপি গ্যাসের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে সে সকল প্রতিষ্ঠান “এলপি গ্যাস অপারেশনাল লাইসেন্সিং নীতিমালা, ২০১৭” এ বর্ণিত সকল ব্যবসা পরিচালনা করতে ইচ্ছুক হলে এ নীতিমালা প্রকাশের তারিখ থেকে ২ বছরের মধ্যে উক্ত প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত প্ল্যান্ট বা প্ল্যান্টসমূহের এলপি গ্যাস মজুদ ট্যাংকসমূহের ধারণ ক্ষমতা ন্যূনতম ৫ পাঁচ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত করতে হবে। তবে যৌক্তিক কারণে উল্লিখিত মজুদ ক্ষমতা উন্নীত করতে না পারলে সরকার আরো এক বছর সময় বৃদ্ধি করতে পারবে।” ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী আগামী ২২ জানুয়ারির মধ্যেই (এক বছর বর্ধিত ধরে) স্টোরেজ ক্যাপাসিটি ৫ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত করতে হবে।
চট্টগ্রামের এলপিজি অপারেটর বিন হাবিব গ্রুপের উপদেষ্টা ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বর্তমান বিশ্বে এলপিজি একটি অগ্রসরমান খাত। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশগত ক্ষতি কমিয়ে আনতে এলপিজির ব্যবহার ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। যে কারণে বিশ্বে এলপিজি চালিত গাড়ির উৎপাদনও দ্রুত বাড়ছে। বাংলাদেশেও এলপিজির চাহিদা ও আমদানি দুটোই বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘আরো ১৫-২০ বছর আগে থেকে এলপিজি ব্যবসা শুরু হয়। ২০১৭ সালে এলপি গ্যাস অপারেশনাল লাইসেন্সিং নীতিমালা হওয়ার আগে ২০১০-১১ সাল থেকে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ১২-১৩টি অপারেটর কার্যক্রম শুরু করে। তখন ন্যুনতম স্টোরেজ ক্যাপাসিটির বিষয়টি ছিল না। ২০১৭ সালের নীতিমালা প্রকাশের দুই বছরের মধ্যে এলপিজি অপারেটরদের জন্য স্টোরেজ ক্যাপাসিটি ন্যুনতম ৫ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত করার জন্য বলা হয়েছে। পুরনোদের মধ্যে এখনো ৪-৫টি অপারেটর ৫ হাজার টনের স্টোরেজ করতে পেরেছে। মূলত ন্যুনতম ৫ হাজার টন স্টোরেজ ক্যাপাসিটির শর্ত জুড়ে দেয়া মানে ভবিষ্যতের এলপিজি ব্যবসা ব্যক্তিবিশেষের হাতে তুলে দেয়ার পাঁয়তারা মাত্র।’ এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রভাব কাটিয়ে বড় বড় কিছু মাফিয়া কোম্পানি এলপিজির পুরো বাজার নিজেরা কুক্ষিগত করতে নীতিমালার শর্তগুলো নিজেদের পক্ষে করে নেয়। বর্তমান নীতিমালা শর্তের কারণে বেশ কয়েকটি পুরনো অপারেটর বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যে কয়েকটি অপারেটর খুঁড়িয়ে চলছে। এতে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্যাংকের যে বিনিয়োগ রয়েছে সেগুলোও হুমকিতে পড়বে।’
এলপিজি বোটলার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লাবাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পদ্মা এলপিজির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো.শামীম চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আমরা ২০১৭ সালের আগে ব্যবসা শুরু করেছি। তখন মিনিমাম স্টোরেজ ক্যাপাসিটির বিষয়টি কোথাও উল্লেখ ছিল না। স্টোরেজ ক্যাপাসিটি দুই হাজার মেট্রিক টন থাকলে ভালভাবে অপারেশনাল কার্যক্রম চালানো সম্ভব হয়। এখন নীতিমালায় ৫ হাজার মেট্রিক টন করার শর্ত দেয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘নতুন অপারেটর যারা ব্যবসায় আসছে তারা নীতিমালা জেনেই আসছে। কিন্তু যারা ২০১৭ সালের নীতিমালা হওয়ার আগে এলপিজি ব্যবসায় এসেছে, প্লান্ট তৈরি করেছে, বোতল আমদানি করেছে, তাদের জন্য ন্যুনতম স্টোরেজ ক্যাপাসিটির শর্ত বাতিল করা উচিত। এখন ছোট অপারেটরদের স্টোরেজ ক্যাপাসিটি ৫ হাজার টন করতে হলে প্রত্যেককে আবার কয়েকশ কোটি টাকার অপ্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে হবে।’
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের যুগ্মসচিব (অপারেশন) ড. মহ. শের আলী গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘এলপিজি গ্যাস নিয়ে ২০১৬ সালের একটি, ২০১৭ সালের একটি নীতিমালা রয়েছে। তাছাড়া অটোগ্যাস নীতিমালা রয়েছে একটি। এই তিনটি নীতিমালা একত্রিত করে একটি নীতিমালা করার কাজ চলছে।’ ন্যুনতম ৫ হাজার মেট্রিক টন স্টোরেজ ক্যাপাসিটির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টি নিয়ে এখনো নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়নি।’