লেবাননের বিখ্যাত কবি খলিল জিবরানের একটি কবিতা আছে ‘শিশু’ নামে। এই কবিতায় মানবশিশুর বেড়ে ওঠা, অভিভাবক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং তাদের সুস্থ মানসপট গঠনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন কবি। জিবরান বলেন, তোমার সন্তানেরা তোমার নয়।/ তারা জীবনের প্রয়োজনে জীবনের পুত্র ও কন্যা সন্তান।/ তারা তোমার মাধ্যমে জীবন পেয়েছে কিন্তু তুমি তাদের উৎস নও,/ এবং যদিও তারা / তোমার সাথে থাকে কিন্তু তুমি তাদের মালিক নও। সন্তানদের তুমি ভালোবাসতে পারো, কিন্তু তাদের চিন্তা–ধারাকে প্রভাবিত করতে পারো না/ কারণ তাদের নিজস্ব চিন্তা–ধারা আছে/ তুমি শারিরীকভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারো, কিন্তু তাদের আত্মাকে না,/ কারণ তাদের আত্মার অস্তিত্ব আগামীকালে, যা তুমি দেখতে পাও না, এমনকি স্বপ্নেও না।/ তুমি হয়তো তাদের মতো করে নিজেকে গড়ার চেষ্টা করতে পারো, তবে তাদেরকে তোমার মতো করার চেষ্টা করো না। /কারণ জীবন কখনো অতীতের সাথে তাল রাখে না বা অতীতে ফিরে যায় না।/ তুমি হলে ধনুক, তোমার ছেলেমেয়েরা জীবন্ত তীর।/ ধনুকের মালিকের দৃষ্টি অসীমের দিকে, এবং তিনি তোমার নিয়ন্ত্রক। /ধনুকের মালিকের হাতে তোমার সমর্পণ হোক আনন্দের /কারণ যদিও তিনি উড়ন্ত ধনুক ভালোবাসেন, ভালোবাসেন স্থির তীরকেও। জিবরানের উপরোক্ত কবিতা শিশুর প্রতি যত্নবান এবং দায়িত্বশীল আচরণ করার দীক্ষা দেয় আমাদের। কিন্তু, পরিতাপের বিষয় সমাজে শিশুদের আমরা সচেতনভাবে বড় করার বিষয়টা খুব বেশি জোর দিয়ে করি না। খালি অসুস্থ হলেই আমরা দৌড়াই। বাকিসময় তাদের স্বাস্থ্যের কথা আমরা ভাবি না।
মানব শিশুর জীবনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শুরু হয় স্কুলে যাওয়ার দিন থেকে। বাবা–মায়ের কাছাকাছি থেকে বড় হওয়া একজন শিশু যখন হঠাৎ করে স্কুলে যাওয়া আসা শুরু করেন তখন তার ভেতরে নানারকম পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। সেটা হোক শারীরিক বা মানসিক। স্কুল পড়ুয়াদের শরীর স্বাস্থ্যের কথা আমরা ভাবি কম। তাদের ব্যস্ত রাখি স্কুলের ক্লাস, কোচিং ক্লাস, হাউস টিউটরের কাছে পড়া এবং ভালো রেজাল্ট করা– এসব চাপে। সহযোগিতামূলক কারিকুলামের পরিবর্তে আমরা বেছে নিয়েছি প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা। যেখানে প্রতিযোগিতা হয় কে কয়জন প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ে, কয়টা ব্যাচে পড়ে অথবা কত নাম্বার পায়। এদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও বন্ধুত্বের গড়ে উঠছে না এই তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে। আজকালকার স্কুল শিশুরা যেনো কার্ল মার্ক্স বর্ণিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিটালিস্ট সোসাইটির প্রোডাক্ট। তারা নানাভাবে বিচ্ছিন্ন। নিজের সত্তা, বন্ধুবান্ধব, নিজের কর্মক্ষমতা এবং সহপাঠীর কাছ থেকে এরা তীব্রভাবে বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকরী পদক্ষেপ হতে পারে সহযোগিতামূলক কারকুলাম এবং সুস্থ দেহ মন। স্কুল পড়ুয়াদের এই বিষয় মাথায় রেখেই কাজ করেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মাননীয় মেয়র ‘জনতার মেয়র’ খ্যাত ডা শাহাদাত হোসেন।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায় দেশে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) পরিচালিত বিদ্যালয়সমূহের শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করা হল ‘স্টুডেন্টস হেলথ কার্ড’। এ বছরের ২১ মে কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। প্রাথমিকভাবে পাঁচটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান–পাথরঘাটা সিটি কর্পোরেশন বালক উচ্চ বিদ্যালয়, গুলএজার বেগম সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়, ইমারাতুন্নেসা কিন্ডারগার্টেন,পাঁচলাইশ কিন্ডারগার্টেন এবং কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এ উদ্যোগের আওতায় আনা হয়েছে। মেয়র জানান, এ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে চসিকের অন্যান্য স্কুলগুলোতেও এই স্বাস্থ্য কার্ড কার্যক্রম চালু করা হবে। তিনি বলেন, ‘শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষা শুধু অভিভাবকদের নয়, বরং প্রতিষ্ঠান ও সিটি কর্পোরেশনেরও দায়িত্ব। এই হেলথ কার্ডের মাধ্যমে শিশুদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, টিকাদান এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে একটি সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব হবে।’ তিনি আরও জানান, প্রধান উপদেষ্টা মহোদয়কেও এই প্রকল্প সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে এবং তিনি উদ্যোগটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়মিত মূল্যায়নের পাশাপাশি হেলথ কার্ডের মাধ্যমে আগাম রোগ শনাক্তকরণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির সুযোগ থাকবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। মেয়র আরো আশা প্রকাশ করেন, ‘এই উদ্যোগ শুধু চট্টগ্রামেই নয়, দেশের অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও একটি রোল মডেল হবে। এ কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীদের শৈশব থেকে দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে ক্লিন, গ্রীন, হেলদি চট্টগ্রাম গড়ে তোলা। ব্যক্তিগত হাইজেনিক লাইফ মেইন্টেন করা থেকে শুরু করে নিজের শহরটাকে পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ববোধ আমরা শিশুদের মাঝে জাগাতে চাই।’
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশান কর্তৃক গৃহীত এই অভিনব উদ্যোগের নীতিমালা পর্যালোচনা করে জানা যায় স্টুডেন্টস হেলথ কার্ডে শিক্ষার্থীর পরিচিতিমূলক তথ্য যেমন নাম, জন্মতারিখ, বিদ্যালয়ের নাম, শ্রেণি, অভিভাবকের নাম ও যোগাযোগ ঠিকানা সংরক্ষণের সুযোগ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি ৫ থেকে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত মোট ১৪ বার স্বাস্থ্য পরীক্ষার রেকর্ড সংরক্ষণ করা যাবে। পরীক্ষায় ওজন, উচ্চতা, দাঁতের অবস্থা, চোখ–কান, ত্বক–চুলের স্বাস্থ্য, রক্তচাপ এবং হিমোগ্লোবিনের তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
বাংলাদেশে মৃত্যুর প্রধান কারণগুলো হৃদরোগ এবং ক্যান্সার। জীবনধারা, আচরণ, শিক্ষা এবং প্রতিরোধমূলক প্রচেষ্টার সাথে ব্যাপকভাবে সম্পর্কিত, শারীরিক কার্যকলাপ এবং খাদ্যাভ্যাসের উপর সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। স্কুলে যাওয়ার বয়সী শিশুদের প্রায়শই খারাপ খাদ্যাভ্যাস থাকে, যার ফলে স্কুল হেলথ কার্ড চালু করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। আমাদের খুব কম শিক্ষার্থীই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নির্দেশিত খাদ্য নির্দেশিকা পূরণ করছে। তাদের খাদ্যাভ্যাসে সাধারণত ফল এবং শাকসবজির অভাব থাকে এবং অতিরিক্ত পরিমাণে চর্বিযুক্ত খাবার থাকে। তাই স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি এবং শিশু স্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য স্কুল হেলথ কার্ড চালু খুব জরুরি বিষয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশানের মেয়র একজন চিকিৎসক। তিনি তাঁর প্রফেশনাল জ্ঞান ব্যবহার করে স্কুল হেলথ চালু করার মতো অভিনব ও জনগুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়ে নগরবাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছেন বেশ।
কমিপ্রহেনসিভ স্কুল হেলথ প্রোগ্রাম (ঈঝঐচ) হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি জাতীয় প্রোগ্রাম যা স্কুলগুলিতে শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য প্রচেষ্টা চালায়। যেহেতু স্কুলগুলি তরুণদের স্বাস্থ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলে, তাই ঈঝঐচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রোগ্রামটি একটি জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থা, আমেরিকান স্কুল হেলথ অ্যাসোসিয়েশন (অঝঐঅ) দ্বারা সমর্থিত, যা স্কুল–বয়সী শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশানের উদ্যোগে চালু হওয়া স্কুল হেলথ কার্ডও আমেরিকার কমপ্রিহেন্সিভ স্কুল হেলথ প্রোগ্রামের মতো কার্যকর ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োগ ঘটানোর উদাহরণ বাস্তবিকভাবে খুবই কম। পেশায় চিকিৎসক মেয়র তাঁর অর্জিত প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাগত দক্ষতার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন দেশে প্রথমবারের মতো স্কুল হেলথ কার্ড চালু করে। তাঁর এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে টেকসই উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর কাজে একটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও অনুবাদক।