চট্টগ্রাম সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। তিনি এমন এমন কিছু কাজের সূচনা করছেন, যেগুলো সত্যিই ব্যতিক্রম ও অনন্য। সেইসব অনন্য কাজের মধ্যে একটি হলো– চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত স্কুলসমূহে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করতে চালু করা হচ্ছে ‘স্কুল শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য কার্ড’। এটি রীতিমত অভাবনীয় ও সময়োচিত পদক্ষেপ। শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর সূত্র মতে, সরকারি–বেসরকারি মিলিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি ৭০ লাখ। প্রতিবছরই এ সংখ্যা বাড়ছে।
প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিচর্যার অভাব, চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতার কারণে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এক বিরাট অংশ ব্যাপক অপুষ্টিসহ বিভিন্ন রোগের শিকার। এতে বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার যেমন কমে যায়, তেমনি ব্যাহত হয় তাদের মেধা ও মননের বিকাশ। যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব প্রতিফলিত হয়ে জাতীয় জীবনে। এ বিষয়টার গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন সিটি মেয়র। তিনি নিজে চিকিৎসক বলে তাঁর দায় অন্যদের চেয়ে একটু বেশি। আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, আগামী বুধবার (২১ মে) কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন স্কুলে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে এ কার্যক্রমের। বুধবার প্রাথমিকভাবে পাথরঘাটা সিটি কর্পোরেশন বালক উচ্চ বিদ্যালয়, গুল এজার বেগম সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়, ইমারাতুন্নেসা কিন্ডারগার্টেন, পাঁচলাইশ কিন্ডারগার্টেন, কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয় এ ৫টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের এ কার্যক্রমের আওতায় আনা হবে। এ অভিজ্ঞতা থেকে পরবর্তীতে চসিকের বাকী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ কার্যক্রমের আওতায় আনা হবে।
গত বৃহস্পতিবার টাইগারপাসস্থ চসিক প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক প্রস্তুতিমূলক সভায় এ সিদ্ধান্ত জানান মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, শিশুদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখা শুধু অভিভাবকদের দায়িত্ব নয়, বরং প্রতিষ্ঠান ও সিটি কর্পোরেশনেরও দায়িত্ব। এই উদ্যোগের মাধ্যমে শিশুদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, টিকাদান এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য নিবন্ধনের মাধ্যমে একটি স্বাস্থ্যবান প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এই স্বাস্থ্য কার্ডের বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টা মহোদয়কেও অবহিত করেছি। তিনি সিটি কর্পোরেশনের এ উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
স্টুডেন্ট’স হেলথ কার্ডটিতে শিক্ষার্থীর নাম, জন্ম তারিখ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম, শ্রেণি, পিতা–মাতার নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বরসহ প্রয়োজনীয় সব পরিচিতিমূলক তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পাশাপাশি কার্ডে পাঁচ বছর বয়স থেকে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত মোট ১৪ বার স্বাস্থ্য পরীক্ষার রেকর্ড রাখার সুযোগ রাখা হয়েছে। প্রতিবার স্বাস্থ্য পরীক্ষায় শিক্ষার্থীর ওজন, উচ্চতা, দাঁতের অবস্থা, চোখ ও কান পরীক্ষার ফলাফল, ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্য, রক্তচাপ এবং হিমোগ্লোবিন লেভেল লিপিবদ্ধ করা হবে। কার্ডের একটি পৃথক অংশে রয়েছে টিকাদান রেকর্ড, যাতে জন্মের পর থেকে নিয়মিতভাবে গ্রহণযোগ্য টিকাগুলোর তালিকা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন বিসিজি, পোলিও, হেপাটাইটিস–বি, এমআর, পেন্টাভ্যালেন্টসহ অন্যান্য অতিরিক্ত টিকা যেমন টায়ফয়েড, হেপাটাইটিস–এ, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং র্যাবিস। মেয়র আরও বলেন, এই কার্ডের মাধ্যমে প্রতিটি শিশুর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়মিতভাবে মূল্যায়ন ও নজরদারি করা সম্ভব হবে। এতে করে আগাম রোগ শনাক্তকরণ ও সচেতনতা বাড়বে। এ উদ্যোগ শুধু চসিক নয়, দেশের অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও একটি উদাহরণ হয়ে উঠবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী তাঁর এক লেখায় লিখেছেন, শিশুবয়সে সুস্বাস্থ্য আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে স্কুল–স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে গণ্য করা নিতান্তই জরুরি। স্কুল পড়ুয়াদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে তৈরি হবে দেশের উজ্জ্বল স্বাস্থ্যচিত্র। এ কারণে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিতে ‘স্কুলস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা’কে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি আরো লিখেছেন, স্কুলের জীবনধারায় ছাত্র–ছাত্রীরা নতুন অনেক কিছু শেখে। যেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে তাদের উদ্বুদ্ধ করা যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাপ্ত স্বাস্থ্য সম্পর্কিত এসব জ্ঞান পরবর্তীতে এরা ঘরে ও সমাজে প্রয়োগ করে। এভাবে দেশব্যাপী স্বাস্থ্যকর পরিবেশ আন্দোলন গড়ে তোলা যায়। যার ইতিবাচক প্রভাব পরিষ্ফুটিত হয় দেশের সার্বিক স্বাস্থ্যসূচকে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন যেভাবে তাদের পরিচালিত স্কুলে ‘স্কুল শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য কার্ড’ চালু করছে, তেমনি অন্যন্য স্কুলেও এ গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিটা চালু করা প্রয়োজন। শুধু চসিক নয়, দেশের অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও এটি উদাহরণ হয়ে উঠবে বলে সিটি মেয়র যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, সেটা যথার্থ বলে আমরা মনে করি।