সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের আওতায় নগরের কাস্টমস মোড় থেকে পতেঙ্গা মোড় পর্যন্ত রাস্তার উভয় পাশে ১৪টি যাত্রী ছাউনি নির্মাণে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাথে ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর চুক্তি করেছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবি কর্পোরেশন। অথচ দুই বছরে মাত্র পাঁচটি যাত্রীছাউনি নির্মাণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া যাত্রী ছাউনির দুইপাশে ৫০ ফুট করে ১০০ ফুট সৌন্দর্যবর্ধন করার থাকলেও নির্মিত যাত্রী ছাউনিগুলোর দুইপাশে কোনো ধরনের সৌন্দর্যবর্ধন ও সবুজায়ন করেনি প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি নির্মিত যাত্রীছাউনিগুলোতে নেই বসার পর্যাপ্ত বেঞ্চ। এছাড়া স্টিল স্ট্রাকচার ও গ্লাস বেষ্টিত ছাদ করার কথা থাকলেও তাও মানা হয়নি নির্মিত যাত্রীছাউনিগুলোতে।
দৈনিক আজাদীর অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে। শুধু কাস্টমস থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প এলাকায় নয়, গত ১৫ দিন ধরে সরেজমিন পরিদর্শনে অধিকাংশ সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এমন গাফিলতি লক্ষ্য করা গেছে।
এদিকে চসিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নগরে সৌন্দর্যবর্ধনে ৪২টি চুক্তি করে সিটি কর্পোরেশন। গত মাসে প্রতিটি সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে একটি গোপন প্রতিবেদন তৈরি করে সংস্থাটির রাজস্ব বিভাগ। এতেও সৌন্দর্যবর্ধনে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো চুক্তি লঙ্ঘনের বিষয়টি ওঠে আসে। চুক্তি বহির্ভূত কোনো স্থাপনা নির্মাণ করেছে কিনা এবং চুক্তির কোন কোন শর্ত লঙ্ঘন করেছে তা অনুসন্ধান করাই ছিল প্রতিবেদন তৈরির উদ্দেশ্য। প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেন চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মুফিদুল আলম। এর আগে গত ১৯ আগস্ট চসিকের আইন কর্মকর্তা মো. জসীম উদ্দিন সৌন্দর্যবর্ধন বিষয়ে একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন জমা দেন প্রশাসককে। এতে চুক্তির শর্ত ভেঙে নকশাবহির্ভূত কোনো কাজ বা স্থাপনা নির্মাণ করেছে তা সরেজমিন যাচাইয়ের সুপারিশ করা হয়েছিল। এরপ্রেক্ষিতেই সরেজমিন পরিদর্শন করে রাজস্ব শাখা প্রতিবেদন তৈরি করে। রাজস্ব বিভাগের প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে জানা গেছে, মাত্র ছয়টি প্রতিষ্ঠান চুক্তি মেনে কাজ করেছে। বাকি ৩৬টি প্রতিষ্ঠান কোনো না কোনো ভাবে চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। এর মধ্যে ১০টি প্রতিষ্ঠান দৃশ্যমান কোনো কাজই করেনি। এছাড়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠান চুক্তি বহির্ভূত দোকান নির্মাণ করেছে ফুটপাতে।
এ বিষয়ে প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মুফিদুল আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, সবগুলো প্রতিষ্ঠানের সাথে বৈঠক করেছি। যেখানে যেখানে চুক্তি লঙ্ঘন হয়েছে তা সংশোধনের জন্য নির্দেশ দিয়েছি। অন্যথায় চুক্তি বাতিল করব। কিছু প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সমস্যার কথাও জানিয়েছে। যেমন করোনা পরিস্থিতির জন্য কাজ করতে না পারা এবং রাস্তা চলমান কাজের জন্যও সমস্যার কথা বলেছে।
চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন দৈনিক আজাদীকে বলেন, আইন বহির্ভূত যা কিছু হয়েছে তার বিরুদ্ধে আমরা অ্যাকশনে যাচ্ছি। যেমন ইতঃপূর্বে বিপ্লব উদ্যান ও স্টেডিয়াম এলাকায় ব্যবস্থা নিয়েছি।
যেভাবে চুক্তি লঙ্ঘন করেছে : গত বছরে ১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় মোড় থেকে প্রবর্তক মিয়া বিবি শোরুম পর্যন্ত ফুটপাত মিড আইল্যান্ডের সৌন্দর্যবর্ধনে চসিকের সাথে চুক্তি করে এড গার্ডেন নামে একটি প্রতিষ্ঠান। অথচ সরেজমিন পরিদর্শনের চসিকের টিম ফুটপাতে কোনো সৌন্দর্যবর্ধন এবং একটি অংশ ছাড়া বাকি জায়গায় সৌন্দর্যবর্ধন দেখতে পায়নি। আরশিনগর নামে একটি প্রতিষ্ঠান চুক্তি করে গত বছরের ২২ জানুয়ারি। চুক্তি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করেনি প্রতিষ্ঠানটিও। এ বিষয়ে চসিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ফুটপাত ও মিড আইল্যান্ডে কোনো সৌন্দর্যবর্ধন কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়নি। প্রসঙ্গত, গোলপাহাড় থেকে এম. এম. আলী রোড, আলমাস সিনেমা মোড় থেকে ওয়াসা মোড়, জিইসি মোড়ে সেন্ট্রাল প্লাজার সম্মুখে ফুটপাত, ভঙ্গিশাহ মাজার চত্বর থেকে কদমতলী নিচের মোড় পর্যন্ত সৌন্দর্যবর্ধন ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার কথা প্রতিষ্ঠানটির। চুক্তি অনুযায়ী, যাত্রী ছাউনির এক তৃতীয়াংশে স্টল ও দুই-তৃতীয়াংশে যাত্রীদের বসার জায়গা থাকার কথা। যা ওয়াসা মোড়ের যাত্রী ছাউনিতে ছিল না।
২০১৮ সালের ডিসেম্বর চুক্তি করলেও তা বাস্তবায়ন করেনি ‘আলিফ এ্যাড ব্যাংক’। প্রতিষ্ঠানটি পাঁচলাইশ চত্বর, কাতালগঞ্চ অলি খাঁ মসজিদ থেকে মুরাদপুর মোড় পর্যন্ত এলাকায় সৌন্দর্যবর্ধন করার কথা। চুক্তিতে থাকলেও ফুটপাতে কোনো উন্নয়ন করেনি, লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করেনি এবং দুটি যাত্রীছাউনির একটিও নির্মাণ করেনি।
‘শেঠ প্রপার্টিজ’ গত পহেলা জানুয়ারি নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা রোডস্থ চট্টগ্রাম কলেজের হোস্টেল গেইট থেকে তেলপট্টি মোড় পর্যন্ত উভয়পাশ ফুটপাত ও মিডআইল্যান্ড সৌন্দর্যবর্ধনে চুক্তি করে। প্রতিষ্ঠানটি রাস্তার দুইপাশে একটি করে যাত্রী ছাউনি নির্মাণের কথা থাকলেও করেনি বলে চসিকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে আরো বলা হয়, চুক্তি মেনে রাস্তায় রোড মার্কিং ও জেব্রা ক্রসিং করা হয়নি। এছাড়া রসিক হাজারী লেইনের মুখে একটি এবং তেলিপট্টি মোড়ে একটি গোল চত্বর নির্মাণ করার কথা থাকলেও করেনি।
এছাড়া ২ নম্বর গেইট থেকে জিইসি মোড়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ এসটিডি ইন্টারন্যাশনাল একটির জায়গায় দুটি যাত্রীছাউনি নির্মাণ করে। নাসিরাবাদ স্কুলের সামনে গণশৌচাগার নির্মাণের কথা থাকলেও নির্মাণ করেনি। একইপ্রতিষ্ঠান আগ্রাবাদ জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের সামনেও চুক্তি মেনে গণশৌচাগার স্থাপন করেনি। বাদামতলী মোড় থেকে জনতা ব্যাংক পর্যন্ত অংশে সৌন্দর্যবর্ধন করার কথা থাকলেও তা দেখতে পায়নি চসিকের পরিদর্শক দল। ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রতিষ্ঠানটি চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল।
২০১৮ সালে চুক্তিবদ্ধ আদিওস ইঙ্ক এবং ক্রিপ্ট নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান প্রবর্তক থেকে গোলপাহাড় এলাকায় চুক্তি অনুযায়ী যাত্রীছাউনি এবং একটি গণশৌচাগার নির্র্মাণ করেনি। একই বছর চুক্তিবদ্ধ জে.এন কর্পোরেশন সিটি গেইট থেকে অলংকার মোড়ের কিছু অংশে ফুটপাতে সৌন্দর্যবর্ধন করে বাকিগুলো করেনি। এমনকি চুক্তি মেনে গণশৌচাগারও করেনি। এছাড়া হলোগ্রাম মার্কেটিং ও মেসার্স সাইন পোস্টও চুক্তি লঙ্ঘন করেছে।
অবৈধ দোকান নির্মাণ : চসিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, জামালখান মোড়ে পিডিবি অফিসার্স কোয়ার্টার সংলগ্ন ফুটপাতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘লিংক এ্যাপারেলস’ অবৈধভাবে পাঁচটি দোকান ও একটি গণশৌচাগার নির্মাণ করেছে। গ্রিড এ-ওয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং নামে আরেক প্রতিষ্ঠান পাঁচলাইশ মক্কী মসজিদের সামনে চুক্তির বাইরে দুইটি ফুড স্টল করেছে। এমনকি ফুটপাতে পথচারীদের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রাখেনি। এছাড়া চুক্তি মেনে কোন সৌন্দর্যবর্ধনও করেনি।
সিএমপির আপত্তি : গত ১ জানুয়ারি ‘ট্রেড ম্যাঙ’ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লালখান বাজার থেকে মুরাদপুর বীর মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভারের রক্ষণাবেক্ষন, সৌন্দর্যবর্ধন ও পে-পার্কিং কার্যক্রম বাস্তবায়নে’ চুক্তি করে। যদিও সিএমপি থেকে পে-পার্কিংয়ের বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়েছে।
কোনো কাজ হয়নি যেখানে : গত ১ জানুয়ারি চসিকের সাথে সৌন্দর্যবর্ধন ও সবুজায়নে চুক্তি করে‘ এঙটেনসিভ মিডিয়া’। চুক্তির আওতায় দুই নস্বর গেইট থেকে অঙিজেন মোড় পর্যন্ত মিড আইল্যান্ড, রাস্তার উভয়পাশ ফুটপাত ও গোলচত্বরসমূহ এবং সল্টগোলা ক্রসিং থেকে শাহীন গলফ ক্লাব পর্যন্ত মিড আইল্যান্ড ও রাস্তার উভয়পাশ ল্যান্ডস্কেপিং, সবুজায়ন ও আলোকায়ন করার কথা। যদিও এখনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি কোনো ধরনের উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধন করেনি। প্রতিষ্ঠানটি সময় চেয়ে প্রশাসকের কাছে আবেদন করে।
গত ১ মার্চ চুক্তি করে দুটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ‘ইনোভেটিভ মিডিয়া’ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মর্গ থেকে অলিখাঁ মসজিদ পর্যন্ত উভয় পাশের ফুটপাত ও মিডআইল্যান্ড সৌন্দর্যবর্ধন করার কথা। এছাড়া ‘ই.এস.কর্পোরেশন’ নামে অপর প্রতিষ্ঠান সাগরিকা মোড় থেকে জহুর আহম্মদ চৌধুরী স্টেডিয়াম পর্যন্ত ফুটপাত ও মিডআইল্যান্ড সৌন্দর্যবর্ধন করার কথা। অথচ পরিদর্শনে চসিকের টিম দেখতে পায়, ‘ই.এস.কর্পোরেশন’ তফসিল এলাকায় কোনো সৌন্দর্যবর্ধন ও উন্নয়ন কাজ করেনি। তবে অন্য একটি প্রকল্পের আওতায় সেখানে ফুটপাত ও মিডআইল্যান্ডের কাজ চলছে। ‘ইনোভেটিভ মিডিয়া’ও কাজ করেনি।
২০১৯ সালের ১ নভেম্বর দুটি প্রতিষ্ঠান চুক্তি করে। এর মধ্যে ‘লীরা আর্ট’ ঈদগাঁহ কাঁচা রাস্তা থেকে অলংকার মোড় পর্যন্ত ফুটপাত ও মিডআইল্যান্ড সৌন্দর্যবর্ধনে এবং ‘সৃষ্টি এ্যাড কমিউনিকেশন’র সাথে কাজীর দেউড়ি মোড় থেকে লাভ লেইন পর্যন্ত পূর্ব অংশের ফুটপাত সৌন্দর্যবর্ধনে এ চুক্তি করে। যদিও চুক্তি অনুযায়ী কোনো কাজ করেনি প্রতিষ্ঠান দুটি।
২নং গেইট মোড়, শেখ ফরিদ মার্কেটের কর্নার থেকে এস.এ.পরিবহন কর্নার পর্যন্ত আধুনিকায়ন ও নাগরিক সুবিধার উন্নয়নে গত ১ ফেব্রুয়ারি ‘মিডিয়া টেন্ডস’ চুক্তি করে। প্রতিষ্ঠানটিও চুক্তি অনুযায়ী কাজ করেনি। গত বছর ১৫ অক্টোবর চুক্তি করলেও হাউজিং মোড় থেকে একে খান মোড় পর্যন্ত রাস্তায় সৌন্দর্যবর্ধন ও সবুজায়ন করেনি ‘ভিউ প্লাস’।
গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর শোলকবহর ও বহাদ্দারহাট এলাকায় তিনটি গোলচত্বরের সৌন্দর্যবর্ধন ও এখলাচুর রহমান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে সৌন্দর্যবর্ধন ও যাত্রী ছাউনি নির্মাণে চুক্তি করে ‘ভ্যালু এ্যাড’। চুক্তির কিছু কিছু বিষয় বাস্তবায়ন করেনি প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে চসিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বহাদ্দারহাট বাজারের সামনে মিড আইল্যান্ডে গোল চত্বরে ট্রাফিক পোস্ট স্থাপনের কথা থাকলে কররেনি, এখলাছুর রহমান স্কুলের সামনে যাত্রীছাউনি স্থাপন হয়নি। এছাড়া সৌন্দর্যবর্ধন হলেও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না বলেও উল্লেখ করা হয়।
গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি চুক্তি করলেও কোন কাজ করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘আইকনিক সাইন’। চুক্তি অনুযায়ী, ২নং গেইট মোড়ের পূর্ব পাশ, বহদ্দারহাট পুলিশ বঙের পশ্চিমে, চকবাজার প্যারেড কর্নারের উত্তর-পশ্চিম কর্নারে যাত্রী ছাউনি নির্মাণ সংলগ্ন জায়গায় সৌন্দর্যবর্ধন করার কথা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সৌন্দর্যবর্ধন ও যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করেনি।