সৌদিদের উদারতা ও নীরবে দানশীলতা

মোয়াজ্জেম হোসেন | শুক্রবার , ২১ নভেম্বর, ২০২৫ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

হাতেম তাই কোনো রূপকথা বা উপকথার গল্পের নায়ক ছিলেন না। সৌদি আরবের হাইল শহরের অধিবাসী হাতেম বিন আবদুল্লাহ বিন সাদ আততাই ছিলেন একজন আরব যোদ্ধা, শাম্মারের শাসক এবং কবি। যিনি তার অসাধারণ দানশীলতা ও উদারতার জন্য বিশ্বজুড়ে প্রবাদপুরুষে পরিণত হন। আজ দেড় হাজার বছর পরেও মানুষ শ্রদ্ধাভরে এই নামটি স্মরণ করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের অনন্য দানশীল ব্যক্তি, বিশ্বের বড় ইসলামি ব্যাংক ও বড় খেজুর বাগানের মালিক শেখ সুলায়মান আল রাজীর দুহাতে তার দানের কথা কিংবদন্তি হয়ে আছে। সৌদি আরবের আল কাসিম প্রদেশে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় খেজুর বাগানটি তাঁর। তিনি এ বাগানটি আল্লাহর রাস্তায় পুরোপুরি ওয়াকফ করে দিয়ে দেন। রমজানে কাবা শরিফ ও মসজিদে নববি এবং অন্য মসজিদসমূহে এ বাগানের খেজুর দিয়েই ইফতার করানো হয়। মুসলিম দেশগুলোতে এ বাগানের খেজুরই উপহার হিসেবে পাঠানো হয়। এর আয় দরিদ্রদের জন্য ব্যয় করা হয়। আরবীয়দের উদারতা, বদান্যতা ও দানশীলতা হাজার বছর ধরে চলমান তাদের সংস্কৃতির অংশ।

পানি পান করানো অত্যন্ত উত্তম সদকা। হাদিসে এর প্রতি উৎসাহী করা হয়েছে। ইবনে আব্বাস রা. বর্ণিত হয়েছে, রাসুল সা. বলেছেন, ‘সর্বোত্তম সদকা হলো পানি পান করানো। পানি পান করানো নিজের এবং নিজের মৃতদের জন্য সদকায়ে জারিয়ার একটি উৎস। সৌদি আরবজুড়ে প্রতিটি মসজিদে দেখেছি ফ্রিজ। এই ফ্রিজগুলো ৫০০ মি.লি. বোতলজাত পানিতে ভর্তি থাকে। ফ্রিজের বাইরেও কার্টন ভর্তি ঠান্ডা পানি স্তূপ করে রাখা হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় মুসল্লিরা এখান থেকে পানি সংগ্রহ করে। অনেক মসজিদে খেজুরও রাখা থাকে মুসল্লিদের জন্য। প্রতিদিন এই পানি ও খেজুর কে দিচ্ছে কেউ জানে না। মক্কা হারাম শরিফের ২য় ও ৩য় তলার তাওয়াফ এলাকা ও বিভিন্ন প্রবেশমুখে চা, কফি, গাহওয়া ও খেজুর পরিবেশন করতে দেখা যায়। সৌদি আরবে বিনামূল্যে পরিবেশিত এইসব খাবারকে ছবিল বলা হয়।

সৌদি আরবে ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে দানশীলতার চর্চা বিশেষভাবে প্রচলিত, বিশেষ করে রমজান মাসে ইবাদত ও দানখয়রাতের প্রতিযোগিতা চলে। রমজান আসলেই শুরু হয় ঈদের আনন্দ। অভাবীদের ঘরে ঘরে খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি পৌঁছে দেওয়া হয়। সবাই নিজের দান গোপন করতে সচেষ্ট থাকেন। রোজাদারকে ইফতার করানোর জন্য সৌদিদের রয়েছে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। ইফতার করানোর জন্য রাস্তার মোড়ে মোড়ে এবং মসজিদে মসজিদে স্থাপন করা হয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশেষ তাঁবু। বছর জুড়ে যেসব ভিনদেশী শ্রমিকরা সৌদিদের সেবায় নিয়োজিত থাকেন, রমজান মাসে এসব তাঁবুতে দেখা যায় তার উল্টো চিত্র। মেহমান হয়ে বসে থাকেন বিভিন্ন দেশ থেকে আসা কর্মীরা। আর খাদেমের মতো তাদের সামনে ইফতার বিতরণের কাজ করেন সৌদিরা। রোজাদারের সেবার নিমিত্তে বহু তাঁবু ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক উদ্যোগে স্থাপন করা হয়। আরও মজার বিষয় হলোকোন তাঁবু কে স্থাপন করেছেন তা জানার কোনো উপায় নেই। অনেক বেসরকারি এনজিও ট্রাফিক সিগনাল ও চেকপোস্টগুলোতে ইফতার বিতরণের ব্যবস্থা করেন।

মসজিদে নববিতে সারা বছরই সোমবার ও বৃহস্পতিবার ইফতারের আয়োজন থাকে, বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। এছাড়াও মক্কা হারাম শরিফ মদিনা হারাম শরিফে ইতেকাফকারীদের জন্য প্রচুর খাবারের ব্যবস্থা থাকে।

আমাদের দেশে রমজান আসার আগেই নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি শুরু করেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। তবে সৌদি আরবের সুপার মার্কেটগুলোর দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিভিন্ন কোম্পানি ও সুপারমার্কেট নিত্যপণ্যে প্রচুর ছাড়ের ব্যবস্থা করে। যাতে সবাই তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য পবিত্র মাসে সহজে কিনতে পারে।

দেনার দায়ে কারাগারে আটক বা দুর্ঘটনায় অর্থদণ্ডের স্বীকার সামর্থহীন বন্দীদের মুক্তির জন্য দানশীল ব্যক্তির পক্ষ হতে সবার অগোচরে জেল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দেনা শোধ করে তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গরিব ও সহায় সম্বলহীন রোগীদের চিকিৎসা খরচ বা হাসপাতালের বিল বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে চিকিৎসাধীন ব্যক্তি বা পরিবারের অগোচরে বিল পরিশোধ করে দিয়ে থাকে। সৌদি আরবে বাংলাদেশের প্রধান পরিচয় পরিচ্ছন্নতা কর্মী রপ্তানীকারক হিসেবে। এই পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা মাত্র ৫০০/৬০০ রিয়াল বেতন পেয়ে থাকে, যা বাংলাদেশি টাকায় ২০ হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এরাও মূলত হাজিদের প্রদত্ত বকশিস ও আরবীদের দানশীলতার ওপর নির্ভর করে প্রবাসে জীবিকা নির্বাহ করে।

হজ মৌসুমে বিশেষ আরাফাত মাঠে সরকারের অনুমোদনপ্রাপ্ত বিভিন্ন কোম্পানি কভার ভ্যান নিয়ে খাদ্য পানীয়, জুস, বিস্কিট ও কেকসহ বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী হাজিদের জন্য বিনামূল্যে প্রদান করে থাকে।

ইসলাম ধর্মের শুরু যেখানে, সেই সৌদি আরবে মাহে রমজান ও ইফতার যে বিশেষভাবে উদযাপিত হবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। সৌদিরা সাধারণত ইফতারের পর সেহরি পর্যন্ত জেগে থাকে। তাই সৌদি ইফতারের আয়োজনটাও হয় অনেক জাঁকজমকপূর্ণ। পুষ্টিকর খাবারে পরিপূর্ণ সৌদি ইফতারে থাকে উন্নত মানের খেজুর, আঙ্গুর রসের শরবত, লাবান, বিভিন্ন ধরনের স্যুপ, তামিজ (একধরনের রুটি), বোরাক (মাংসের পিঠা), মেনদি অথবা ভেড়া/মুরগির মাংস দিয়ে তৈরি খেপসা।

আরবীয় সংস্কৃতিতে উদারতা ও দানশীলতা একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবিক গুণ, যা ইসলাম ধর্মের দ্বারা বিশেষভাবে উৎসাহিত। এই উদারতা কেবল ক্ষমাশীলতা ও সহনশীলতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, মানবিকতা ও পরোপকারী মনোবৃত্তিকেও বোঝায়। সৌদি আরবে এই দানসমূহ নীরবে, নিভৃতে কোন প্রদর্শনী ব্যতিরেকে, কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দিচ্ছে তাও জানার সুযোগ নেই। আমাদের দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণ ও পরিচালনায় সৌদি আরবের শেখ, ধনাঢ্য ব্যক্তি ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সহায়তা পেয়ে থাকে। এছাড়াও সৌদি সরকার প্রদত্ত ও বিভিন্ন এনজিও’র মাধ্যমে দারিদ্য বিমোচন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও খাদ্য সামগ্রীসহ বিভিন্ন রকম সহায়তা পেয়ে থাকে।

রমজান মাসে সরকারিবেসরকারি সকল পর্যায়ে শ্রমিকদের ডিউটি কমিয়ে দেওয়া হয়। এমনিতে সৌদিতে প্রতি মাসের বেতনভাতা মাস ফুরানোর আগেই ২৫ তারিখে পরিশোধ করা হয়। তবে রমজান মাসে তা আরও এক ধাপ এগিয়ে ২০ থেকে ২২ তারিখের মধ্যেই বেতনভাতা পরিশোধ করা হয়।

আরবীয় সংস্কৃতিতে উদারতা এবং নীরবে দানশীলতা একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ যা কোরআন ও হাদিসে উৎসাহিত করা হয়েছে। এই সংস্কৃতিতে, সম্পদ ও সামর্থ্যের সদ্ব্যবহার করে অভাবীদের সাহায্য করা, প্রয়োজনে নিজের কষ্টার্জিত অর্থ দান করা এবং এমনভাবে দান করা যাতে দাতা ও গ্রহীতা কেউ জানতে না পারে, এমন কাজকে বড় সওয়াবের কাজ হিসেবে দেখা হয়।

লেখক: প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাসুলুল্লাহ (সা.) যে সব বিষয় থেকে আশ্রয় চেয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা