চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালনার জন্য আগামী বুধবার বিদেশি অপারেটর নিয়োগের চুক্তি হচ্ছে। সরকারের পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) অথরিটির তত্ত্বাবধানে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সৌদি আরবের রেড সী গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি) কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করবে।
দেশের আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মোকাবেলায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে গ্রহণ করা হয় পিসিটি নির্মাণ প্রকল্প। চিটাগাং ড্রাইডক লিমিটেডের পাশ থেকে বোট ক্লাব পর্যন্ত আগেকার বিমানবন্দর সড়কের বাঁকগুলো সোজা করে উদ্ধার করা হয় নদীপাড়ের ৩২ একর জায়গা। মূল্যবান এই জায়গায় রেড ক্রিসেন্ট, মেরিন ফিশারিজ, কাস্টমস এফ ডিভিশন, ওমেরাসহ বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি সংস্থার কার্যালয় ছিল। জায়গাটিকে বন্দরের মূল স্রোতে আনার লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পিসিটি নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় ১,২৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে পিসিটি নির্মাণ করে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নকশা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে দেশীয় প্রতিষ্ঠান ই–ইঞ্জিনিয়ারিং এটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে।
পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল পুরোপুরি প্রস্তুত হয় ২০২২ সালের মাঝামাঝি। নির্মাণকাজ শেষ হলে পিসিটি উদ্বোধনের দিনক্ষণও ঠিক করা হয়। কিন্তু পরে তা আর হয়নি। নতুন টার্মিনালটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে পরিচালনার জন্য সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। সরকারের পিপিপি অথরিটি এই টার্মিনালের অপারেটর নিয়োগের জন্য বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশনকে (আইএফসি) পরামর্শক নিয়োগ দেয়। এরই আলোকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েকটি টার্মিনাল অপারেটর পিসিটি পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানসহ সরকারের বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন দিক যাছাই বাছাই করে। একইসাথে কূটনৈতিক নানা সমীকরণ নিয়েও হিসেব নিকেশ করা হয়। অবশেষে সৌদি আরবের রেড গেটওয়ে টার্মিনাল কর্তৃপক্ষকে পিসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্তের আলোকে ইতোমধ্যে নানা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। আগামী ৬ ডিসেম্বর আরএসজিটির সাথে প্রকল্পটি পরিচালনার ব্যাপারে চুক্তি হচ্ছে।
পিসিটি বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনাল হয়ে উঠেছে। অবস্থানগত কারণে এই টার্মিনালে চট্টগ্রাম বন্দরে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় জাহাজগুলোকে অনায়াসে বার্থিং দেয়া যাবে। বাড়তি গভীরতার পাশাপাশি চ্যানেলে কোনো বাঁক না থাকায় পিসিটিতে বড় জাহাজ ভিড়ানোর সুবিধার পাশাপাশি অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত থাকবে বলে শিপিং বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। তারা বলেন, বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে এনসিটি, সিসিটির দূরত্ব যেখানে ১৪–১৫ কিলোমিটার, সেখানে পিসিটির দূরত্ব ৬ কিলোমিটার। বাঁক না থাকায় এখানে বড় জাহাজ ভিড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তাই বিদ্যমান বন্দরের টার্মিনালগুলোর তুলনায় পিসিটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এই টার্মিনালে বছরে প্রায় ৫ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করা যাবে। ৩২ একর জায়গায় নির্মিত টার্মিনালটিতে ১৬ একর ইয়ার্ডসহ বিভিন্ন পশ্চাৎ সুবিধা এবং ৫৮৪ মিটার দীর্ঘ জেটি রয়েছে। জেটি এলাকায় পানির গভীরতা সাড়ে ১১ মিটার হলেও ১০ থেকে সাড়ে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানো যাবে। এই টার্মিনালে ১৯০ মিটার লম্বা ও ১০ বা সাড়ে ১০ মিটার ড্রাফটের ৩টি কন্টেনার জাহাজ একসাথে এবং ২২০ মিটার দীর্ঘ ডলফিন জেটিতে ১টি ভোজ্যতেলবাহী জাহাজ ভেড়ানো যাবে। তবে ২১০ মিটার বা বেশি ল্যান্থের জাহাজ দুটির বেশি ভিড়ানো যাবে না। টার্মিনালে ১ লাখ ১২ হাজার বর্গমিটারের আরসিসি পেভমেন্ট (অভ্যন্তরীণ ইয়ার্ড ও সড়ক), ২ হাজার ১২৮ বর্গমিটার কন্টেনার ফ্রেইট স্টেশন (সিএফএস) শেড, ৬ মিটার উঁচু ১ হাজার ৭৫০ মিটার কাস্টমস বন্ডেড ওয়াল, ৫ হাজার ৫৮০ বর্গফুটের পোর্ট অফিস ভবন, ১ হাজার ২০০ বর্গমিটারের যান্ত্রিক ও মেরামত কারখানাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে তোলার মাধ্যমে টার্মিনালকে একটি স্বতন্ত্র বন্দরের আদল দেয়া হয়েছে।
টার্মিনালটি পুরোদমে চালু করতে ৪টি কী গ্যান্ট্রি ক্রেন (কিউজিসি), ৮টি রাবার টায়ারড গ্যান্ট্রি (আরটিজি), ৪টি স্ট্রাডেল ক্যারিয়ার, ৪টি রিচ স্ট্যাকার, ১টি রেল মাউন্টেড গ্যান্ট্রি ক্রেন (আরএমজি), ৪টি লো–মাস্ট ফর্ক লিফট, ২টি ফায়ার ট্রাক, ১টি ফায়ার কার, ৩টি নিরাপত্তা পেট্রোল কার, ১টি অ্যাম্বুলেন্স, ৫০ টনের দুটি টাগ বোট, ২টি পাইলট বোট, ২টি ফার্স্ট স্পিড বোটসহ অন্তত ৮শ কোটি টাকার ইকুইপমেন্ট লাগবে। চুক্তি অনুযায়ী পিসিটির প্রয়োজনীয় সব ইকুইপমেন্ট বিদেশি অপারেটর ক্রয় করবে। তারা দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ মোট ২২ বছর এই টার্মিনাল পরিচালনা করবে। এরপর ইকুইপমেন্টসহ বন্দরটি যেভাবে থাকে তা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করবে। আগামী বুধবার চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই টার্মিনালের বিদ্যমান অবকাঠামো আরএসজিটি কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেয়া হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, আগামী ৬ ডিসেম্বর পিসিটির ব্যাপারে চুক্তি হওয়ার প্রাথমিক একটি দিন ঠিক করা হয়েছে।