যে সময় এই লেখা লিখছি সেই সময়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আকাশ পথও বন্ধ করে দিতে বলছেন। ভারতের পাঞ্জাব দিল্লিসহ অনেক প্রদেশে লকডাউন ও কারফিউ চলছে। প্রতিদিনই ভারতে কোভিড ১৯ এর কারণে মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে। ২৬ এপ্রিল একদিনে মৃত্যু ছিল ২৮১২ জন, শনাক্ত তিন লাখেরও বেশি। প্রতিদিন লাফিয়ে বাড়ছে এই পরিসংখ্যান। ভারতের রাজধানী দিল্লির হাসপাতাল সমূহের সামনে মানুষের আহাজারি দেখলে চোখে পানি ধরে রাখা দায়। ডাক্তারকে পর্যন্ত কেঁদে দিতে আমরা ভারতের এনডি টিভিতে দেখেছি। সেখানে সংকট আইসিইউর,অক্সিজেনের। চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন” Triple mutant varient ভারতকে তছনছ করে দিচ্ছে। “করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে “Triple Mutant varient অনেকের মতে Nigerian Varient এ আক্রান্ত রোগি প্রথম থেকেই তীব্র শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন অঙিজেনের প্রয়োজন হয়,প্রয়োজন হয় আই সি ইউর। কোভিড এর প্রথম ঢেউয়ে এই ধরনের লক্ষণ ছিলনা।ফলে সারা ভারত জুড়ে আজ অক্সিজেনের অভাব, অভাব দিল্লির মতো শহরে আই সি ইউ।এই অবস্থায় সৌদী আরব ২৬ এপ্রিল ৮০ মেট্রিক টন অক্সিজেন ভারতের জন্য জাহাজীকরণ করেছেন। ২৬ এপ্রিল সাংবাদিক সঞ্জয় কুমার একটি প্রতিবেদনে লিখেছেন ” অতিমরির দ্বিতীয় ঢেউ ভারতকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছে এবং প্রতিদিন তিন লক্ষেরও বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।দিল্লির প্রতিদিনের অঙিজেন এর চাহিদা ৭০০ শত মেট্রিক টন, কিন্ত তারা পাচ্ছে ৩৮০ যা হাসপাতালগুলোকে ধারনক্ষমতার বাইরে পরিচালনা করতে বাধ্য করছে।”
এই হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অবস্থা যা নিকট প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের জন্য উদ্বেগজনক। কোভিড ১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশেও চলছে। এই রোগে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ২ লক্ষ ৪৮ হাজার ৬২৮। মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১১১৫০ যা ৪ মে তে এসে দাঁড়িয়েছে ১১৭০৫.কোভিড ১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ে বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েছে যা লকডাউন পরবর্তীতে কিছুটা কমলেও প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে অনেক বেশি। ৪ মে মৃত্যুবরণ করেছে ৬৮জন। ২৬ এপ্রিল ৯৭,২৩ এপ্রিল মৃতের সংখ্যা ছিল ৮৮, ২২ এপ্রিল ৯৮,২১ এপ্রিল ৯৫,২০ এপ্রিল ৯১। এর পূর্বে ৪ দিন ধরে দেশে এই রোগে ১০০ জনের উপরে মৃত্যুবরণ করেছে। আরো উদ্বেগের বিষয় হলো প্লাটফর্ম অব মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল সোসাইটি আপডেট ২৭ এপ্রিল অনুযায়ী বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত বা উপসর্গ নিয়ে বা ভাইরাস পরবর্তী জটিলতায় মৃত্যুবরণকারী চিকিৎসক এর সংখ্যা ২০০জন। চিকিৎসকদের মতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত অধিকাংশই শুরু থেকে শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন যা ভারতের উপসর্গের সাথে মিল পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে করোনার এই ঢেউয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর শতকরা হিসাবে ঢাকা ৭০ % চট্টগ্রাম ২০%বাকি ১০% অন্যান্য জেলায়। তাহলে দেখা যায় রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রাম সবচে বেশি ঝুঁকিতে আছে।২৬ এপ্রিল তারিখে সরকারি তথ্যমতে চট্টগ্রামে করোনায় মোট মৃত্যু ৫০৪ জন। করোনার প্রথম ঢেউয়ে দেশের এক বিশিষ্ট শিল্পপতি তীব্র শ্বাসকষ্ট অনুভব করে নাকি বলেছিলেন আমার কোটি টাকা চাইনা চাই একটু নিঃশ্বাস।এই নিঃশ্বাস এখন আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।মহাখালিতে কোভিড ডেডিকেটেড ডি এন সি সি হাসপাতালে রোগীর ঠাঁই মিলছেনা। ২৩ এপ্রিল ডি এন সি সি হাসপাতালের পরিচালক টেলিভিশনে যে তথ্য দিয়েছেন সেদিন ১৭৪ জন রোগীর মধ্যে ৯৬ জনই ছিল আই সি ইউ রোগী।এদের আবার হাই ফ্লো অক্সিজেন এর প্রয়োজন। এদের অনেকেই বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে এসে আই সি ইউ না পেয়ে খবর পেয়ে শেষ মুহূর্তে এই জায়গায় এসেছেন। তাহলে বুঝা যায় এই মুহূর্তে কোভিড ১৯ দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলার অত্যাবশ্যক হচ্ছে হাই ফ্লো অক্সিজেন সমৃদ্ধ আই সি ইউ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডাঃ নাসরিন মোস্তফা এক জার্নালে প্রকাশিত কিছু তথ্য পাঠকের জন্য তুলে ধরছি যা প্রণিধানযোগ্য। আই সি ইউ পরিচালিত হয় ইনসেনটিভ কেয়ার পিজিসিয়ান দ্বারা। সহযোগিতায় লাগে ট্রেইনি নার্স। ডাঃ নাসরিনের লেখায় জানা যায় আমাদের দেশে আই সি ইউ এর জন্য বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত নার্সের সংখ্যা অপ্রতুল। অনেকেই দেখে দেখে শেখা নার্স যা আই সি ইউর জন্য বিপজ্জনক।বাংলাদেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আছে ৩৭ টি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আছে ৭৬টি। (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে)। ডাঃ নাসরিনের লেখা অনুযায়ী ২০১৮ পর্যন্ত বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালে আই সি ইউ বেড এর সংখ্যা ছিল ২২৩ টি যার সংখ্যানুপাতিক হার ২১৯ঃ১। কিন্ত তার মতে সেই সংখ্যা হওয়ার কথা ১০ঃঃ০১। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো গত ৩ মে মন্ত্রীসভার বৈঠকে দেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিক্ষক নিয়োগের অনুপাতও ঠিক করে দেয়া হয়েছে ১০ঃ১। (সূত্র বি ডি নিউজ) ডাঃ নাসরিনের লেখা জার্নালে বলা হয়েছে দেশের ৭৮% আই সি ইউ বেসরকারি হাসপাতালে। বাংলাদেশে ক্লিনিক বাদে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সংখ্যা ৭৬ টি,যার মধ্যে ৫ টি সামরিক বাহিনী পরিচালিত, ৭ টির মামলা চলছে। (সূত্রঃ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়)।এই বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মোট আই সি ইউ সংখ্যা জানা যায়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চট্টগ্রাম এর তথ্য অনুসারে চট্টগ্রামে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সংখ্যা ৬টি যার মধ্যে আই সি ইউ বেড এর সংখ্যা ৩৮ টি। হাসপাতালগুলোর মোট শয্যা সংখ্যা প্রায় ১৫০০। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চট্টগ্রাম এর তথ্য অনুসারে চট্টগ্রামে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল এর শয্যা সংখ্যা ৪০৫০টি, আই সি ইউ বেড এর সংখ্যা ১৬৬টি,ভেন্টিলেটর ১৫৬টি অঙিজেন সিলিন্ডার ৪৬৫৭টি, হাইফ্লো ন্যাজল ক্যনুলা ১৭৫ টি। (চট্টগ্রাম মহানগর ও ১১ টি জেলায়)। চট্টগ্রামে কোভিড ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতালগুলো হলো ১) চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল যার কোভিড আই সি ইউ ১৮ টি,২)চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাসপাতাল যার কোভিড আইসিইউ নাই ৩)বি আই টি আই ডি যেখানে ৫টি কোভিড আইসিইউ স্থাপনের অপেক্ষায়,৪)হলি ক্রিসেন্ট হাস্পাতালের আই সিইউ ১০টি ৫) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০টি, অর্থাৎ চট্টগ্রামে সরকারি কোভিড ডেডিকেটেড আই সিইউ এর ৪৩ টি। (স্বাস্থ্য অঅধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে)। বেসরকারি হাসপাতাল গুলোতেএকদিনের আই সি ইউ খরচ প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা।করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট যদি তার অপগতি অব্যাহত রাখে তাইলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কি দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়।
ডেইলি স্টার এর মওদুদ আহমদ সুজন এর ২০মার্চ ২০২১ এ লেখা একটি রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট কোভিড আইসিইউ র সংখ্যা ৫৫৮ টি, পাঠক লক্ষ্য করুন দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। সরকার লক ডাউনের সময় ১৬ মে পর্যন্ত বর্ধিত করে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কমাতে সক্ষম হচ্ছেন।কিন্ত মানুষের সচেতনতা ও কঠোর আইন প্রয়োগ জরুরি। যদিও ৪ মে মাস্ক না পড়ার কারণে ঢাকার একটি মার্কেট ম্যাজিস্ট্রেট বন্ধ করে দিয়েছেন যা উদাহরণ।
শুরুতেই আমি উল্লেখ করেছি করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট এ কেউ আক্রান্ত হলেই শুরুতেই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, প্রয়োজন হচ্ছে অঙিজেন ও হাইফ্লো ন্যাজল ক্যনুলা সমৃদ্ধ আই সি ইউ।করোনার তৃতীয় বা চতুর্থ ঢেউ যে আসবেনা তা বিশ্ব বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করতে পারছেনা।তাই এই সময় সরকারের উচিত হবে দেশে যে ৭৬ টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আছে তাদের শয্যানুপাতিক হারে আইসিইউ এবং কোভিড ডেডিকেটেড আইসিইউ স্থাপনের পরিপত্র জারী করা সেইসাথে আইসিইউ এবং কোভিড ডেডিকেটেড আইসিইউ এর খরচ সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কোভিড পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে দেয়াও জরুরি। অনেক বেসরকারি হাসপাতালে ১০০০/ থেকে ২০০০/ টাকা পর্যন্ত কোভিড পরীক্ষার ফি নিচ্ছে যা অনুচিত। এমনও জানা গেছে অনেকে সেম্পল নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে পাঠিয়ে দিয়ে মোটা টাকা ফি নিচ্ছে যা এখনি বন্ধ করা সমীচীন। সরকারি হাসপাতালগুলোতে জেলাওয়ারি কোভিড ডেডিকেটেড আইসিইউ বাড়ানোর সময় এখনি।আইসিইউ সহজ বিষয় নয়।এর জন্য অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও প্রশিক্ষিত নার্স এর প্রয়োজন আছে। এইজন্য বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে ৬ মাস সময় দিতে হবে।
আমাদের অর্থনৈতিক মন্দা, জনসংখ্যা ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে করোনার সম্ভাব্য তৃতীয় বা চতুর্থ ঢেউ মোকাবেলায় প্রস্তুতির সময় এখনই। আমরা দিল্লির দৃশ্য দেখতে চাইনা। তদুপরি চট্টগ্রাম বন্দর শহর।এই বন্দরে বিভিন্ন দেশের নাবিক ক্রুসহ অনেক বিদেশির যাতায়াত। বন্দরের শ্রমিক কর্মকর্তা সংক্রমিত হলে পুরো দেশ অচল হবে। তাই আগামীর বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে সারা দেশে এবং বন্দর নগরী চট্টগ্রামে সমন্বিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। বাড়াতে হবে আইসিইউ, কোভিড ডেডিকেটেড হাইফ্লো ন্যাজল ক্যনুলা সমৃদ্ধ আই সি ইউ। লেখক : ছড়াকার, প্রাবন্ধিক