বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে বাঁকখালী ও মহেশখালী চ্যানেলের মোহনায় চতুর্পাশে সাগর বেষ্টিত মহেশখালী দ্বীপের সন্নিহিত উপদ্বীপটির নাম ‘সোনাদিয়া’। একসময় দ্বীপের সৈকত জুড়ে হাজার হাজার লাল কাঁকড়ার বিচরণ, ম্যানগ্রোভ প্যারাবনে অতিথি পাখির কলকাকলি আর দ্বীপ জুড়ে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ করে শুটকি তৈরীর ধুম পড়ে যেত। সেই জুলুস আর গৌরব এখন কেবলই অতীত। দখল–দূষণ ও প্যারাবন নিধন করে চিংড়ি ঘের তৈরির কালো থাবায় সোনাদিয়া দ্বীপ হারিয়েছে তার রূপ যৌবন।
৯ হাজার ৪৬৭ একর আয়তনের এই দ্বীপের উত্তর–পূর্ব দিকে প্যারাবন (ম্যানগ্রোভ) এবং পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে সমুদ্র সৈকত। গেল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খোদ সরকারের লুলুপ দৃষ্টি পড়েছিল এই দ্বীপের উপর। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) ইকো–ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার শর্তে নামমাত্র মূল্য ১ হাজার ১ টাকার সেলামিতে বরাদ্দ দিয়ে দিয়েছিল। সরকার পতনের পর বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের বিরোধিতায় সরকারের অনুকূলে দেওয়া ৯ হাজার ৪৬৭ একর জমির বরাদ্দ স্থগিত করেছে হাইকোর্ট। অবশেষে এই জমি পুনরায় ফেরত যাচ্ছে বন বিভাগের অধীনে। সোনাদিয়া দ্বীপের পরিবেশ রক্ষার্থে এটি বন অধিদপ্তরের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। বেজার অধীনে থাকাকালীন কতিপয় স্বার্থান্বেষী ভূমিদস্যু অপতৎপরতায় শুরু হয় প্যারাবন উজাড় করে চিংড়ি ঘের তৈরির হিড়িক। এতে দখল ও দূষণে দ্বীপের বিরল প্রজাতির পাখপাখালি, বৃক্ষ ও লতাগুল্ম ধ্বংস অনেকটা ধ্বংস হয়ে যায়।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিবেশ ও পরিবেশ সংকটাপন্ন সোনাদিয়া দ্বীপের জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারে ৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ইতোমধ্যে দ্বীপে প্রাথমিক জরিপ ও পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করেছে। পর্যবেক্ষণকালে সোনাদিয়া দ্বীপের জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার ও বাসিন্দাদের জীবন মানোন্নয়নে সোনাদিয়াবাসীর মতামত গ্রহণ করা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কঙবাজার জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু সহনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বন অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধি নামে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় সোনাদিয়া দ্বীপে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে জমি দখলমুক্ত করা, খালের মুখ ও শাখা–প্রশাখার বাঁধ অপসারণ করে জোয়ারের পানি প্রবাহ সুগম করা, বালিয়াড়ি পুনরুদ্ধার এবং সৈকত সংরক্ষণ এবং ম্যানগ্রোভ ও নন–ম্যানগ্রোভ গাছের চারা রোপণ করা হবে। এছাড়াও দ্বীপের পরিবেশ পুনরুদ্ধারে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। এই প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গত ২৬ অক্টোবর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ফাহমিদা হক খানের নেতৃত্বে একটি পর্যবেক্ষক দল সোনাদিয়া দ্বীপ পরিদর্শন করেন। এসময় তারা দ্বীপের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখেন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। মতবিনিময়কালে পর্যবেক্ষক দল সোনাদিয়া দ্বীপের পরিবেশ–প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন মানোন্নয়নে স্থানীয়দের মতামত গ্রহণ করেন। পরিদর্শন দলে অন্যদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর কঙবাজার জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক খন্দকার মাহমুদ পাশা।
সোনাদিয়া দ্বীপের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মহেশখালী আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি মোসাদ্দেক ফারুকী বলেন, সোনাদিয়ার বিশাল ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট প্রাকৃতিক ঝড়–জলোচ্ছ্বাস থেকে মহেশখালী দ্বীপকে রক্ষা করে থাকে। তাছাড়া এই দ্বীপে বিরল প্রজাতির পশু পাখির অভয়ারণ্য রয়েছে। এই জীববৈচিত্র্য কিছুতেই ধ্বংস হতে দেয়া যায় না। এটি পুনরুদ্ধারে নেওয়া সরকারের এই পদক্ষেপ অত্যন্ত যুগোপযোগী। সরকারের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। এটি বাস্তবায়ন হলে সোনাদিয়া দ্বীপ ফিরে পেতে পারে তার হৃত গৌরব।












