অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলার মানুষগুলো হারিয়ে ফেললাম। এ শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। সৈয়দ আবুল মকসুদ রাজনৈতিক সংকট ও অনিয়মের বিষয়গুলো খুব সহজ করে তুলে ধরতেন পাঠকের জন্য। নির্মোহ ছিল তাঁর বিশ্লেষণ। বাংলাদেশের বেশীর ভাগ লেখার বুদ্ধিজীবী দলীয় বৃত্তের বাইরে যেতে পারেন না। অনেকেই ব্যক্তি স্বার্থে সরকারের অনৈতিক ও অন্যায় কাজগুলোকে সমর্থন করে যান। কিন্তু সৈয়দ আবুল মকসুদ নির্দ্বিধায় সরকারের অনৈতিক ও অন্যায় কাজগুলোর সমালোচনা করতেন খুব সহজ ও রসবোধের মাধ্যমে। গত ১৭/২/২০২১ ‘প্রথম আলোতে’ তার সর্বশেষ লেখাটা প্রকাশিত হয়।
লেখাটার শিরোনাম ছিল “স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে অবিবেচক দৃষ্টান্ত নয়” তিনি লিখেছেন “জিয়াউর রহমানের বীর উত্তম খেতাব প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন প্রত্যাহার করলে মৃত জিয়ার কোন ক্ষতি নেই। তবে যে কোন উদ্দেশ্যই হোক এমন কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত হবে না, যা ভবিষ্যতের কোন সরকার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে অপছন্দের বহু ব্যক্তিকে পদক ছিনিয়ে অপমান করতে পারে।” তিনি আরও লিখেছেন, ‘যদিও জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করেছেন। তাঁর বহু সিদ্ধান্ত সমালোচনা করা যায়। মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন ব্যক্তি ভূমিকা রেখেছেন। সশস্ত্র যুদ্ধে কার কি অবদান সে প্রশ্নের মীমাংসা প্রবাসী সরকারের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে বঙ্গবন্ধু সরকারই ১৯৭৩ সালে করে গেছেন তাঁর উপর কলম চালানো বা তাঁকে চ্যালেঞ্জ করা অতি অশোভন।” সৈয়দ আবুল মকসুদের কলম থেমে গেছে এই বেদনাভার যেন নিতে পারছি না। বড় বেশি মুগ্ধতায় পড়তাম তাঁর নির্মোহ কলামগুলো। শেখারও চেষ্টা ছিল তাঁর লেখা থেকে। তিনি যে শুধু কলাম লেখক ছিলেন তা কিন্তু নয়। তাঁর কর্মকাণ্ডের পরিধি ছিল বিশাল। তিনি একজন পরিবেশবাদী ছিলেন। সাহিত্য অঙ্গনের প্রতিটি শাখায় ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। শুরুই করেছিলেন কবিতা দিয়ে। তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম ‘বিকেল বেলা দারা শিকো ও অনন্য কবিতা।
প্রবন্ধগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ”, ‘বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার,’ ‘রবীন্দ্রনাথের ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন’, ‘ঢাকায় বুদ্ধদেব বসু’ ‘যুদ্ধ ও মানুষের মূর্খতা’, প্রভৃতি। তিনি প্রতি মঙ্গলবার প্রথম আলোতে লিখতেন। ২০০৩ সালে মার্কিনীদের ইরাক আক্রমণের প্রতিবাদে পশ্চিমাদের উদ্ভাবনী সেলাই করা কাপড় পরিত্যাগ করে এই উপমহাদেশের আদি পোশাক সেলাই ছাড়া কাপড় পরিধান করতেন। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ ছিলেন। তিনি বাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি শিকড় সন্ধানী গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তার অসামান্য কাজ একটি জাতির উত্থান ও বিকাশের সাক্ষী। দেশের প্রগতিশীল চিন্তা, গবেষণা ও আন্দোলনের অন্যতম এই অগ্রগামী ব্যক্তিটির জীবন আকর্ষিক থেমে গেল ৭৫ বৎসর বয়সে। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯৪৬ সালে ২৩ শে অক্টোবর মানিকগঞ্জে। তিনি রেখে গেছেন তাঁর দুই সন্তান, স্ত্রী ও অগণিত গুণগ্রাহী পাঠক। প্রিয় লেখকগুলো অজান্তেই পাঠকের খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেন। হয়ে উঠেন স্বজন। তাই স্বজন হারানোর বেদনায় ভারাক্রান্ত মন। তাঁর আত্মার চির শান্তি কামনা করছি।