সালটা সম্ভবত ২০১৯, আমার সঠিক মনে নেই। বি.এস.আর.এম গ্রুপ অব কোম্পানিজ এর এন্যুয়াল ন্যাশনাল সেলস কনফারেন্স বরাবরের মতো সেবারও কঙবাজারে অনুষ্ঠিত হলো। আমার জন্য সেবারের কনফারেন্সটা ছিলো ভীষণ অর্থবহ। কারণ, বেস্ট রিজিওনাল ইনচার্জ (ই২ঈ) ক্যাটাগরিতে আমি সারাদেশে প্রথম স্থান অর্জন করে এম.ডি স্যারের হাত থেকে ক্রেস্ট গ্রহণ করি।
ভীষণ ফুরফুরে মুডে ছিলাম আমি। সমুদ্র সৈকতে আমি একা একা হাঁটছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম, ১২/১৩ বছর বয়সী একটা ছেলে বিশাল এক ক্যামেরা বুকে ঝুলিয়ে আমার পাশেপাশে হাঁটছে। চোখাচোখি হতেই ছেলেটি মাথা চুলকে নিষ্পাপ একটা হাসি দিয়ে বললো… ‘স্যার ছবি তুলবেন?’
আমি হাসিমুখে বললাম, ‘না বাবা, ছবি তুলবো না।‘
ছেলেটি নাছোড়বান্দা। আমার পাশেপাশে হাঁটছে। ‘স্যার, আমি খুব ভালো ছবি তুলি। কয়েকটা ছবি তুলে দিই, পাঁচ টাকা মাত্র।‘
বললাম… ‘স্মার্ট ফোনের এই যুগে টাকা দিয়ে কে ছবি তোলে! তুমি যাও বাবা, আমি ছবি তুলবো না।‘
ছেলেটি কিন্তু হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। হাসিমুখে আমাকে বললো… ‘স্যার, আপনার চেহারা অনেক সুইট, সালমান খানের মতো।’
এবার আমি শব্দ করে হেসে উঠলাম। হাসতে হাসতেই বললাম… ‘তুমি যদি বল… আমাকে টম ক্রুজের মতো লাগছে, তবুও আমি ছবি তুলবো না বাবা। তুমি যাও।’
ছেলেটি এবার একটু থমকে দাঁড়ালো। আর আমি ছেলেটিকে পেছনে রেখে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে শুরু করলাম। হঠাৎ ছেলেটি… ‘স্যার, স্যার‘ বলে দৌড়ে আমার কাছে আসলো। তার ক্যামরার ডিসপ্লে আমাকে দেখিয়ে বললো, ‘স্যার দেখেন আপনাকে কত সুন্দর লাগছে। সালমান খানের মতো।’
আমি চমকে উঠলাম। দেখি ওর ক্যামেরায় আমার ছবি। বললাম, ‘তুমি এই ছবি কখন তুলেছ? পারমিশন ছাড়া কারো ছবি তোলা অন্যায় এটা তুমি জানো?’ ছেলেটি মাথা চুলকে বললো… ‘সরি স্যার। আসলে আপনি যখন একা একা হাঁটছিলেন, বিকেলের আলোতে আপনাকে খুব সুন্দর লাগছিলো, তাই আপনাকে না জানিয়েই ছবিটা তুললাম।’
আমি বললাম, ‘কাজটা কিন্তু ঠিক করোনি। যাই হোক, ছবিটা মুছে দাও।’
আমাকে অবাক করে দিয়ে ছেলেটি বললো… ‘স্যার, আপনার মোবাইলটা দেন, ছবিটা আমি আপনার মোবাইলে ট্রান্সফার করে দিচ্ছি। এটার জন্য আমাকে কোন টাকা দিতে হবে না।’
বাচ্চা একটা ছেলে বিনামূল্যে আমাকে ছবি ট্রান্সফার করতে চাচ্ছে… মাশাল্লাহ, কী দুর্দান্ত এই ছেলের সেইলিং স্কিল! বিনামূল্যে ছবি দেবার কথা বলে সে খুব স্মার্টলি আমার ইগোকে হিট করেছে। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকালাম। বললাম, ‘কী নাম তোমার বাবা…?’
ছেলেটির নাম ফরহাদ। আমি পরম মমতায় ওকে কাছে ডাকলাম। ওর মাথার এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে পকেটে একটা একশো টাকার নোট গুজে দিতে চাইলাম। সে কিছুতেই এই টাকা নেবে না। সে এক শর্তে টাকা নিতে রাজী হলো। সে আমার কয়েকটা ছবি তুলবে।
একটু আগে যে আমি কিছুতেই ছবি তুলছিলাম না, সেই আমিই বাধ্য ছেলের মতো ফরহাদের নির্দেশনায় ছবির জন্য পোজ দিতে লাগলাম। মনে মনে বলছিলাম, ‘হোয়াট এ পারফরমেন্স, হোয়াট এ সেলিং স্কিল!’
আমার মোবাইলে কিছু ছবি ট্রান্সফার করে ফরহাদ চলে গেলো। ছেলেটার প্রতি একটা অদ্ভুত মুগ্ধতা মনে ধারণ করে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে হাঁটছি, আর ভাবছি… বাচ্চা একটা ছেলে, ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সেলসে অভিজ্ঞ পরিণত একজন সেলস পারসনকে নতুন করে শিখিয়ে গেলো… সেলস কীভাবে করতে হয়। আসলে সেলসে শেষ বলে কিছু নেই। সেলসে কখনও গিভ–আপ করতে নেই এবং শেখার কোনও বয়স নেই। সেলস যেন এক বিশাল সমুদ্র, এক অন্তহীন পথচলা, এক বৈজ্ঞানিক শিল্প।