চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হলেও এখনো দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরে মূলত রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে। অথচ দেশের প্রায় সিংহভাগ আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই পরিচালিত হয়। এই চট্টগ্রামে রয়েছে জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজভাঙা শিল্প। এছাড়া ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার চাক্তাই খাতুনগঞ্জ, আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেড, সিইপিজেড এবং কর্ণফুলী ইপিজেডের অবস্থান এই চট্টগ্রামেই। অন্যদিকে মীরসরাইয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে বিশাল ইকোনমিক জোন। এত কিছুর পরেও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছে একরাশ হতাশা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাপ্তরিক অনেক কাজের জন্য এখনো ছুটতে হচ্ছে ঢাকায়। এতে সময় ক্ষেপণের পাশাপাশি হয়রানির শিকারও হতে হচ্ছে। যেমন, চট্টগ্রামে রয়েছে আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তর। কিন্তু এই দপ্তরটিতে কাজের পরিধি দিন দিন সংকুচিত করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম দপ্তর থেকে সর্বশেষ তিনটি সেবা পাওয়া যেত। গত ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সব ধরনের বাণিজ্যিক আমদানি অনুমতি (আইপি) ঢাকা থেকে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ফলে বর্তমানে আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের চট্টগ্রাম দপ্তরে রইল মাত্র দুটো সেবা। আমদানি নিবন্ধন সনদ (আইআরসি), রপ্তানি নিবন্ধন সনদ (ইআরসি) এবং এই দুটি নিবন্ধন সনদ নবায়ন ছাড়া আর কিছু করার ক্ষমতা রাখে না দপ্তরটি। অথচ আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে মোট ৫৫টি সেবা রয়েছে। যার অধিকাংশই এক সময় চট্টগ্রাম দপ্তরে ছিল বলে জানান আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রক দপ্তরের কর্মকর্তারা। সেবা সংকুচিত হওয়ায় এখন চট্টগ্রামের আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তরটিও হয়ে গেছে যেন ঢাল তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার।
আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সব ধরনের আমদানি ও রপ্তানির অনুমতি ঢাকা থেকে নিতে হয়। এছাড়া বহুজাতিক কোম্পানি, যৌথ বিনিয়োগ এবং শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও শিল্প আইআরসি ও শিল্প ইআরসি নিতে ঢাকার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ঢাকা থেকে অনুমোদনের পর চট্টগ্রাম থেকে শুধুমাত্র এসব সনদ ইস্যু করা হয়। অথচ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) চট্টগ্রাম কার্যালয় এবং বস্ত্র অধিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয় শিল্প আইআরসি অনুমোদনের জন্য আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তর ঢাকাকে সুপারিশ করে। অনুমোদন যদি চট্টগ্রাম অফিস থেকে নেয়ার সুযোগ থাকতো তাহলে ব্যবসায়ীদের আর ঢাকায় অযথা সময় নষ্ট করতে হতো না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা ঋণপত্র না খুলে বিদেশ থেকে উপহার সামগ্রী কিংবা পণ্যের সেম্পল আনলে, সেক্ষেত্রে আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে অনুমতি নিতে হয়। গত ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের আগে সেই অনুমতি চট্টগ্রামে মিললেও এখন তা নিতে হচ্ছে ঢাকা থেকে। এছাড়া শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কারখানার যন্ত্রপাতি আনতে ঋণপত্র (এলসি) লাগে না। সেক্ষেত্রে আমদানি অনুমতি (আইপি) নিলেই হয়ে যায়। বর্তমানে সেই অনুমতি নিতেও ঢাকায় দৌঁড়াতে হচ্ছে। আবার প্রবাসী পেশাজীবীরা আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের অনুমতি নিয়ে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং যন্ত্রপাতি আমদানি করতে পারেন। তবে বর্তমানে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিস থেকে সেই ক্ষমতা ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার কারণে এসব পণ্য আনার ক্ষেত্রেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এছাড়া আমদানি অনুমতি এবং বিশেষ ক্ষেত্রে ক্লিয়ারেন্স পারমিট নিয়ে এলসি ছাড়া পণ্য আমদানি করার অনুমতি এখন ঢাকা থেকে নিতে হচ্ছে। অন্ট্রাপো বা সাময়িক আমদানি বাণিজ্যের নিমিত্তে পণ্য আমদানির অনুমতিও ঢাকা নিতে থেকে নিতে হয়। পুনঃরপ্তানির লক্ষ্যে আমদানির অনুমতিও এক সময় চট্টগ্রাম থেকে হতো। তবে তা এখন নিতে হচ্ছে ঢাকা থেকে। তৈরি পোশাক রপ্তানির পর ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় তা ফেরত আসলে বন্দর থেকে খালাস ও পুনঃরপ্তানির অনুমতি কিংবা ত্রুটিযুক্ত কাপড় ফেরত প্রদানের অনুমতিও নিতে হয় ঢাকা থেকে। শুল্ক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আটক পণ্য চালান খালাসে আবেদনও করতে হয় ঢাকা অফিসে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হলেও বাণিজ্যিক অনেক সুযোগ সুবিধাই চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন না। এক সময় আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনেক ক্ষমতা ছিল, ধীরে ধীরে ক্ষমতা ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা এই বিষয়গুলো নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেছি। মন্ত্রী মহোদয়কে কয়েকবার বলেছি। যেখানে সবগুলো বিভাগে কাজ বিকেন্দ্রীকরণ করার কথা, সেখানে চট্টগ্রাম কার্যালয়ের কাজের পরিধি কমিয়ে আনার বিষয়টা মেনে নেয়া যায় না। ঢাকার ওপর নির্ভরশীলতা কমানো উচিত বলে আমি মনে করি। ব্যবসায়ীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম দৌঁড়াদৌঁড়ির করার ফলে তাদের সময় ও অর্থ দুটোই নষ্ট হচ্ছে। তাই অবিলম্বে আগের মতো চট্টগ্রাম আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তরটি গতিশীল করার দাবি জানাচ্ছি।
আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের নিয়ন্ত্রক (নিয়ন্ত্রক) মোহাম্মদ আওলাদ হোসেন দৈনিক আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য আমদানি ও রপ্তানি দপ্তরগুলোতে সেবার পরিমাণ বাড়ানোর বিষয়টি আমরা ভেবে দেখছি। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ী নেতারা মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেছেন। চট্টগ্রাম বাণিজ্যের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা শহর। কারণ এখানে বন্দর রয়েছে। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা যাতে সহজে সেবা পান সেই বিষয়টা মাথা রেখে আমরা ভবিষ্যতে কাজ করবো।