সেন্টমার্টিন নামটি শুনলেই বাংলাদেশের মানুষের শরীরে একটা রিদম তৈরি হয়। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর পূর্বাংশে চারিদিকে সমুদ্র বেষ্টিত একটি প্রবাল দ্বীপ, যার আয়তন মাত্র ৮ বর্গ কিলোমিটার। এটি কঙবাজার থেকে ১২০ কিলোমিটার ও টেকনাফ হতে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে ও মায়ানমার উপকূল হতে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত ক্ষুদ্র একটি দ্বীপ। প্রচুর নারিকেল গাছ আছে বলে এটিকে স্থানীয়ভাবে নারিকেল জিঞ্জিরাও বলা হয়। বাংলাদেশের সমুদ্র প্রেমীদের কাছে এটি ব্যাপক পরিচিত একটি দ্বীপের নাম। যার দৈর্ঘ্য ৬ কিলোমিটার, প্রস্থ অর্ধ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ৯৮০০ জন। এই দ্বীপের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ। তবে পর্যটকের চাপে এই দ্বীপে প্রতিনিয়ত প্রবাল কমছে, কমছে দ্বীপের বৃক্ষরাজিও। নতুন নতুন স্থাপনা বা হোটেল তৈরি হওয়ায় প্রতিদিন এর জীব বৈচিত্র্য বিলুপ্ত হচ্ছে। ফলে দ্বীপটির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যও নষ্ট হচ্ছে। অথচ এই দ্বীপটি বিশ্বে একটি অনন্য দ্বীপ। পলিপ নামে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণির সমন্বয়ে তৈরি হয় এক একটি প্রবাল। প্রবাল বা কোরাল এক ধরনের অমেরুদণ্ডী সামুদ্রিক প্রাণি।এর বহিরাবরণ শক্ত বলে ভুল করে একে পাথর ভাবা হয়। তাই এই শক্ত পাথরকে প্রতিনিয়ত টুকরা টুকরা করে দ্বীপে বিভিন্ন নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হয়। সেই জন্য স্বাধীনতার সময় দ্বীপটিতে যতটুকু ভূমি প্রবালে আচ্ছাদিত ছিলো বর্তমানে তার এক চতুর্থাংশও নেই।এই ভাবে চলতে থাকলে ২০৪৫ সালের মধ্যে এটি পুরাপুরি প্রবাল শূন্য হয়ে যাবে। তখন প্রবাল শুধু যাদুঘরে স্থান পাবে-এই তথ্যগুলো প্রকাশিত হয়েছে ‘জিওস্পাশিয়াল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বঙ্গোপসাগরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রবাল ধ্বংস চিহ্নিত করা’ শীষক গবেষণা নিবন্ধে। যা গত সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক ওশান সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়।
নিবন্ধে বলা হয় সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রচুর পর্যটক এই দ্বীপে বেড়াতে যায়। ১৯৯৬-৯৭ সালে সেন্ট মার্টিনে বেড়াতে যেত মাত্র ২০০ জন। আর বর্তমানে বছরে যায় প্রায় দুই লাখ মানুষ। ১৯৯৬-৯৭ সালে দ্বীপটির জনসংখ্যা ছিলো ৩৭০০ জন আর বর্তমানের জনসংখ্যা প্রায় ৯৮০০। তবে পর্যটন মৌসুমে আরো প্রায় ২৫০০-৩০০০ লোক বাহির থেকে এসে কাজ করে। ২০১২ সালে এখানে হোটেল ছিলো ১৭টি বর্তমানে ৪৮টি। তবে স্থানীয় হিসাব অনুযায়ী সেন্ট মার্টিনে হোটেল মটেল ও কর্টেজের সংখ্যা ১২৫ টি। একসময় দ্বীপটির আয়তন ১৩ বর্গ কিলোমিটার হলেও বর্তমানে তা ৮ বর্গ কিলোমিটার। চারিদিকে ভাঙনের কারণেই এমনটি হয়েছে। তাই এ দ্বীপকে রক্ষায় অতিদ্রুত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের ভিত্তিতে বাঁধ নির্মাণ করা জরুরি। স্থানীয় জনগণের সাথে কথা বলে জানা যায় এই দ্বীপের প্রবাল শৈবাল রক্ষায় সরকারের কোন উদ্যোগ নেই। তবে দুই বছর ধরে স্থানীয়রা প্রবাল উত্তোলন ও পাচার রোধে কাজ করছেন। তারা আরো বলেন পর্যটকেরা যে পরিমাণ বর্জ্য ফেলে যান তা অপসারণে সরকারি কোন বরাদ্দ বা ব্যবস্থা নেই। ফলে এসব বর্জ্য সাগরে পড়ে সাগরকেও দূষিত করছে।
সেন্ট মার্টিনের বর্তমান অবস্থা বুঝতে গবেষকরা স্যাটেলাইট হতে ১৯৮০ হতে ২০১৮ পর্যন্ত তোলা ছবি বিশ্লেষণ ও মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করে দেখেন, ৩৮ বছরে দ্বীপটির প্রবাল আচ্ছাদন ১.৩২ বর্গ কিলোমিটার হতে কমে হয়েছে ০.৩৯ বর্গকিলোমিটার। প্রবাল প্রজাতি ১৪১টি থেকে কমে হয়েছে ৪০টিতে। বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা ৪.৫ বর্গকিলোমিটার হতে কমে হয়েছে ৩ বর্গকিলোমিটারে। গবেষণায় সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ দূষণ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির জন্য কয়েকটি মানবসৃষ্ট কারণকে চিহ্নিত করা হয়। যার মধ্যে অন্যতম অনিয়ন্ত্রিত পর্যটক, আবাসিক হোটেলের বর্জ্য, পর্যটকদের ব্যবহৃত সামগ্রী সমুদ্রে নিক্ষেপ, পাথর উত্তোলন, প্রবাল উত্তোলন ও উপকূলীয় এলাকায় মাছ ধরার জালের যত্রতত্র ব্যবহার। গবেষকরা আরো বলেছেন, সেন্ট মার্টিনে নতুন জন্মানো প্রবালগুলো জেলেদের জালের টানে নষ্ট হয়ে যায়। দেখা যায় জেলেরা দ্বীপের চারপাশে তীর থেকে প্রায় ৫০০-১০০০ মিটার উপকূলীয় এলাকায় জাল ফেলে মাছ ধরে। যেখানে সবচেয়ে বেশি প্রবাল জন্মায়।
গবেষকরা আরো বলেন, সামুদ্রিক দ্বীপে প্রবাল জন্মানোর নিয়মক হলো জলরাশির তাপমাত্রা, পানিতে লবণের পরিমাণ, বালুকনার পরিমাণ, পানির অম্লতা, ঢেউয়ের তীব্রতা,দ্রবীভূত অক্সিজেন ইত্যাদি। তবে প্রধান নিয়ামক হচ্ছে অক্সিজেন। ধীরে ধীরে এই নিয়ামক গুলোর প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এজন্য কিছু প্রাকৃতিক কারণও রয়েছে। দ্বীপের চারপাশের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন ও সামুদ্রিক জলের রাসায়নিক পরিবর্তন যার মধ্যে অন্যতম। বিজ্ঞানীরা আরো বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপ জীববৈচিত্র্যের দিক দিয়ে পৃথিবীর মধ্যে অনন্য। সেখানে স্বচ্ছ পানির কারণে প্রবাল জন্ম নেয়। নির্বিচারে পর্যটক যেতে দেওয়ায় পানি দূষিত হয়ে যায়। ফলে প্রবাল জন্মাতে পারে না। তাই বিজ্ঞানীদের আশংকা এখন যেভাবে পর্যটক আসছে ও অসচেতনভাবে এর রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে, তাতে একসময় সেন্টমার্টিন দ্বীপ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
অন্যদিকে ভূরাজনৈতিক কারণে সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। বিশাল সমুদ্রে তদারকি ও দেশের নিরাপত্তার জন্য এই দ্বীপটির গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর যে কোন দেশে গভীর সমুদ্রে এই ধরনের একটি দ্বীপ সেই দেশের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য একটি বড় এসেট। সেই প্রক্ষিতে এখানে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের স্থাপনা রয়েছে এবং সমুদ্রে মনিটরিং এর জন্য রয়েছে টহল জাহাজ। তাই সরকারকে এখনই পর্যটকের বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া দরকার। কারণ দেশের নিরাপত্তা আগে নিশ্চিত করে তবেই পর্যটনের চিন্তা করা উচিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সাধারণ সম্পাদক,
চবি গণিত অ্যালামনাই এসোসিয়েশন