অতিসম্প্রতি কে বা কারা ‘শান্তিপূর্ণভাবে সেন্ট মার্টিন হস্তান্তরের কাজ চলছে। সেন্ট মার্টিন এড়িয়ে চলুন’ মর্মে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি বহুল প্রচারও পেয়েছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ নিয়ে এসব কদর্য অপপ্রচারের উৎস কোথায় তার উপলব্ধি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ইতিমধ্যেই ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষ থেকে এ সম্পর্কে বক্তব্যে বলা হয়েছে, কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মনোবৃত্তি বাংলাদেশের নেই। তবে দেশ আক্রান্ত হলে কঠিনভাবে তার সমুচিত জবাব দেওয়া হবে। সম্মানিত সেনা প্রধানও একই ধরনের বক্তব্যে বলেন, ‘দেশপ্রেমিক সেনা বাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সম্পূর্ণ প্রস্তুত ও সক্ষম।’ এ ধরনের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা নিয়ে বিভিন্ন টকশো থেকে শুরু করে নানা আলাপ–আলোচনা জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনায় জানা যায়, মিয়ানমারের রাখাইনে চলমান সংঘাতের জেরে বিগত কয়েক দিন যাবৎ নাফ নদীর নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকায় মিয়ানমার সীমান্ত থেকে বাংলাদেশি পণ্যবাহী ট্রলার ও স্পিডবোট লক্ষ্য করে বেশ কয়েকবার গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। গুলিবর্ষণের ঘটনায় টেকনাফ–সেন্টমার্টিন নৌপথে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় দ্বীপে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট দেখা দেয়। যদিও বঙ্গোপসাগর দিয়ে দ্বীপবাসীর সংকট মোচনে ভিন্ন পথে খাদ্যদ্রব্য পৌছানো হয়েছে। উল্লেখ্য ঘটনায় মানুষ ও পণ্যের ক্ষতি না হলেও এ নিয়ে আতঙ্ক–আশঙ্কার অন্ত নেই।
১৬ জুন ২০২৪ আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মিয়ানমারে চলমান অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যৌথ অপারশেন পরিচালনা করছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এবং আরাকান আর্মির এই সংঘর্ষের কারণে নাফ নদী ও নদী সংলগ্ন মোহনা এলাকায় বাংলাদেশি বোটের ওপর অনাকাঙ্ক্ষিত গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে গত ১২ জুন প্রতিবাদ জানায়। এরই ধারাবাহিকতায় মিয়ানমার নৌবাহিনী সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অদূরে মিয়ানমারের সমুদ্রসীমায় এবং নাফ নদীর মিয়ানমার সীমানায় অবস্থান করে মিয়ানমারের দিকে আরাকান আর্মির অবস্থান লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করছে। একই সঙ্গে আরাকান আর্মিও মিয়ানমার নৌবাহিনীর জাহাজ ও বোট লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বর্তমানে মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমার নৌবাহিনীর একাধিক যুদ্ধজাহাজ অপারেশন পরিচালনা করছে। মিয়ানমার নৌবাহিনী সেন্ট মার্টিনের অদূরে মিয়ানমারের সমুদ্রসীমায় অবস্থানের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে অবহিত করছে।
আমাদের সকলের জানা, ২০০৮ সালে মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যের লাইজাতে বিদ্রোহীগোষ্ঠী কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মির (কেআইএ) সহায়তায় আরাকান আর্মি প্রতিষ্ঠিত হয়। আরাকানের আদিবাসী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ২৬ তরুণকে নিয়ে গঠিত বিচ্ছিন্নতাবাদী এই গোষ্ঠীর বর্তমান সদস্য সংখ্যা প্রায় সাত হাজারেরও বেশি। রাখাইন রাজ্যকে মাতৃভূমি হিসেবে ফেরত পাওয়াই তাদের লক্ষ্য বলে ২০১৪ সালে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয় আরাকান আর্মি। ২০১৬ সালের শেষের দিকে শান রাজ্যে উত্তরাঞ্চলীয় জোটের অংশ হিসেবে মিয়ানমার সেনবাহিনীর বিরুদ্ধে কাচিনদের পাশাপাশি লড়াইয়ে নামে আরাকান আর্মির সদস্যরা। পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশস্ত্র এই গোষ্ঠীটি তাদের স্বপ্ন পূরণে অনেকদূর এগিয়েছে। রাখাইনের স্বাধীনতার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে সশস্ত্র আন্দোলন করে আসা আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের অনেকাংশে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। রাখাইনের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে আরাকান আর্মির। তাদের সদস্যরা মিয়ানমারের চিন রাজ্যের পালেতোয়া এবং রাখাইন রাজ্যের কাইয়ুকতা, বুথিডং, রাথেডং ও পনিয়াগুনে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করেছে।
মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তা’য়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং আরাকান আর্মি (এএ) ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে জোটবদ্ধ হয়ে ব্রাদারহুড অ্যালোয়েন্স গঠন করে। পরবর্তীতে শুরু হয় অপারেশন ১০২৭ নামে জান্তা সরকারের ওপর সমন্বিত আক্রমণ। অপারেশন ১০২৭ এর অংশ হিসেবে ২০২৩ সালের ১৩ নভেম্বর আরাকান আর্মি রাথেডং, মংডু ও মিনবাইয়া শহরে পাঁচটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। অপারেশন শুরুর পর ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ১৬টি শহর এবং প্রায় ৫০০টি জান্তা ঘাঁটি দখল করেছে। আরাকান আর্মি প্রতিবেশি চিন রাজ্যের পালেতোয়া শহর এবং উত্তর রাখাইন ও পালেতোয়া টাউনশিপের ১৬০টির বেশি সামরিক জান্তা ঘাঁটি ও ফাঁড়ি দখলে নিয়েছে। উল্লেখ্য অপারেশনে ২০টি শহর ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথসহ শান রাজ্যের বেশিরভাগ এলাকা দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি। জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে চীনের মধ্যস্ততায় জান্তা সরকারের সাথে যুদ্ধবিরতির চুক্তি করার পর আরাকান আর্মি এই রাজ্যে অভিযান পরিচালনা বন্ধ রাখে। কিন্তু রাখাইন ও চিন প্রদেশের পালেতোয়া টাউনশিপ এলাকায় বৃহৎ পরিসরে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ চলতি মাসের ১৭ তারিখ মংডু টাউনশিপের অবশিষ্ট ঘাঁটিগুলো দখলে নিতে সেখানকার বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে আরাকান আর্মি।
স্মরণযোগ্য যে, স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল নির্মাণ অব্যাহত ছিল। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি কিংবা মার্চ মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানে আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড ইসলামাবাদ থেকে ঢাকায় এসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করেছিল। বৈঠকে জোসেফ ফারল্যান্ড হাতিয়া বা সেন্ট মার্টিন দ্বীপে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে দেওয়ার শর্তে বঙ্গবন্ধুর নিকট বিনা রক্তপাতে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে রাজি করার প্রস্তাব দেয়। সে সময় অনেকেই ধরণা করেছিল যে, বঙ্গবন্ধু হয়তো ফারল্যান্ডের শর্তে রাজি হবেন। কিন্তু বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সেই দিনের বৈঠকে ফারল্যান্ডকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘মিস্টার ফারল্যান্ড আমি আপনাকে চিনি, আপনি ইন্দোনেশিয়া এবং আর্জেটিনায় সামরিক অভ্যুত্থানের হোতা। আমি শিয়ালের কাছ থেকে দেশ বাঘের হাতে তুলে দিতে পারবো না।’ একইভাবে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য তনয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অদম্য অগ্রগতিতে এগিয়ে যাওয়া সরকারের ওপর এই বিষয়ে নানামুখি প্রভাব পরিলক্ষিত। বিশেষ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে এর তীব্রতা গভীর অনুভূত।
২১ জুন ২০২৩ সংবাদ সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেন্টমার্টিন দ্বীপ কাউকে লিজ দিলে ক্ষমতায় থাকতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু সেটা আমার দ্বারা হবে না। আমি দেশের কোনও সম্পদ কারো কাছে বিক্রি করে ক্ষমতায় আসতে চাই না। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল কীভাবে? তখন তো গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিল। তাহলে এখন তারা দেশ বিক্রি করবে? নাকি সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বিক্রি করার মুচলেকা দিয়ে আসতে চায়? আমি তো এইটুকু বলতে পারি, আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুবর রহমানের কন্যা, আমার হাত দিয়ে এই দেশের কোনো সম্পদ কারও কাছে বিক্রি করে আমি ক্ষমতায় আসতে চাই না। ঐ গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিলে আমিও ক্ষমতায় থাকতে পারতাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখনও যদি বলি ঐ সেন্টমার্টিন দ্বীপ বা আমাদের দেশ লিজ দেব, তাহলে আমার ক্ষমতায় থাকার কোনো অসুবিধা নেই। আমি জানি সেটা। কিন্তু আমার দ্বারা সেটা হবে না।’
দুঃখজনক হলেও সত্য, সেন্টমার্টিন নিয়ে চলমান অপপ্রচারকে পুঁজি করে বিরোধী দলের মুখপাত্র যে বক্তব্য রেখেছেন তা শুধু অনভিপ্রেত–অবাঞ্ছিত নয়; দেশ বিরোধী চক্রান্ত হিসেবে অনুমেয়। এই ধরনের মিথ্যা–বানোয়াট–ভিত্তিহীন দেশবিরোধী প্রচার–প্রচারণা দেশের সার্বভৌমত্বকে ভূলুন্ঠিত করার শামিল। অচিরেই নিগূঢ় তদন্তের মাধ্যমে কথিত অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠিন আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ অতীব জরুরি। যেকোন ধরনের জঙ্গি–মৌলবাদি–সন্ত্রাসী এবং দেশবিধ্বংসী কার্যকলাপের সাথে নূন্যতম আপস দেশবাসী মেনে নেবে না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশপ্রেমিক বাঙালিরা অজস্র প্রাণ বিসর্জনে দেশ স্বাধীন করেছেন। ধারাবাহিকতায় দেশের এক ইঞ্চি মাটিও কেউ দখলে নেওয়ার অপচেষ্টা করলে জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে শত্রুদের প্রতিহত করবেই।
বর্তমানে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশী–বিদেশি চক্রান্ত চলমান। পরাজিত অন্ধকারের শত্রুরা ছদ্মবেশে ও ছলচাতুরীর আড়ালে সরকার–দলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। জনশ্রুতি মতে, দেশের উন্নয়ন–প্রয়োজনীয় নীতি নির্ধারণেও তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। স্বাধীনতা বিরোধী, বঙ্গবন্ধুর হত্যার ক্ষেত্র তৈরি ও সরাসরি হত্যার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা অশুভ উদ্যোগে ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বিভিন্ন পদ–পদায়ন–পদক দখলে অনৈতিক অর্থ লেনদেন–তদবির–লবিং বাণিজ্যের বদৌলতে তাদের কুৎসিত শক্তিমানতা সহজেই অনুমেয়। উচ্চশিক্ষা থেকে শুরু করে দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় তাদের পদচারণায় জনমনে অসন্তোষ বিরাজ করছে। সেন্ট মার্টিন নিয়ে অপপ্রচার ও বিদেশী শক্তির যোগসাজশে দেশে অরাজকতা বা অস্থিরতা সৃষ্টিতে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। তাদের চরমভাবে অপদস্ত করে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণে সর্বক্ষেত্রে দেশ সুরক্ষার এখনই উপযুক্ত সময়। অন্যথায় সাধারণ জনগণের ক্ষোভ প্রকাশ অধিকমাত্রায় হতাশাব্যঞ্জক–যন্ত্রণাদগ্ধ হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়