ড্রংইরুম বাংলায় বসার ঘর এটি সব বাড়িতে থাকে বিশেষত অতিথিরা এলে বসার জন্য। তাই একালে বলেন সেকালে বলেন এটির ‘সাজসজ্জা’ ঘরের গিন্নীর এখতিয়ারভূক্ত। তাঁরা নিজের রুচি ও পছন্দমতো গৃহের ওই অংশটি মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজাতেন বাড়ির অন্যান্য রুমগুলোর তুলনায়। তবে সেকেলে এই রুমসজ্জায় একটি অতি সাধারণ ব্যাপার লক্ষণীয় তা হচ্ছে, পিতলের ফুলদানিতে অর্ধেক পানি নিয়ে ডাঁটাসমেত ছিঁড়ে নেয়া রংবেরঙের ফুলের ডালগুলো পিতলদানীতে দিয়ে এর চারপাশে হরেক রকমের পাতাবাহার দিয়ে সজ্জিত করে তা ছোট্ট ‘টি টেবল’ যা সাদাকুরশি কাটার রুমালে ঢাকা তার উপর বসিয়ে দিতেন। তখনকার দিনে বিত্তভেদে গ্রাম, শহর, মফস্বলের প্রায় সব বাড়ির সন্মুখে ছোট বড় শখের ফুলবাগান ছিল। বাগান ছাড়া খুব কম বাড়ি দেখা যেতো, এখন যা শুধুই কল্পনা!
বাড়ির স্কুল পড়ুয়া মেয়েটি ফুলদানির বাসি পানি বদলে দিত, বাসিফুলের ঝরা পাপড়ি পরিষ্কার করে দিত নিজ থেকেই। আরেকটি ‘টি টেবল’এ পত্রিকা, গেজেট ইত্যাদি গুছানো থাকতো যেখানে সাপ্তাহিক বিচিত্রা, মাসিক গণস্বাস্থ্য, দৈনিক ইত্তেফাক, বহুলপঠিত আজাদী গুছানো থাকতো। এর পাশে আরেকটি টুলে ছাইদানি থাকতো ধূমপায়ী অতিথিদের জন্য।
ট্রানডিসটার, টেবিলঘড়ি, কোন কোন বাড়িতে হারমোনিয়াম, গিটার, তবলা কখনো বসার ঘরে কখনো শোবার ঘরে আনানেওয়া চলতো প্রয়োজনে। তখনও চট্টগ্রামের বনেদি এককথায় স্বচ্ছল বাড়ির বসার ঘরগুলোতে সাদাকালো টিভি সেটের উপস্থিতি কল্পনাতীত ব্যাপার!
দেয়ালে পেণ্ডুলাম দেয়া বড় বা মাঝারি সাইজের কাঠের সুদৃশ্য ঘড়ি, যা ডিংডং ডিংডং করে সময় জানিয়ে দিত, তার পাশে একটুখানি নীচে দিনপঞ্জি ঝুলতো। দাদার ছবি অথবা বাড়ির কোনো সদস্যের সমাবর্তনের ছবি, পরিবারের ছোট্ট আদুরে ছেলে-মেয়ের গোলগাল, আদুরে চেহারার ছবি মাঝারি বা বড় সাইজের ফটোফ্রেমে বাঁধানো যা দেয়ালের শোভা বাড়াতো অনেকখানি।কোনো কোনো সচ্ছল বাড়ির বসার ঘরে রুচিভেদে সোফাসেট ছাড়াও নরমগদি সাঁটানো কমলালেবু আকৃতির সিলেটি গোলবেত ও বাঁশের তৈরি মোড়া থাকতো দু’চারটি, রুমের একপাশে সরুলম্বা ডিভান কুরশিকাটার ধবধবে চাদরে ঢাকা, যা রুমের সৌন্দর্য্য অনেকখানি বাড়িয়ে দিতো। বাড়ির গিন্নি ফুলদানিতে সুগন্ধি ছড়ায় এরকম ফুল দিতে পছন্দ করতেন। সববাড়িতে বসার ঘরের মেঝে কার্পেটে মোড়ানো থাকতো না, তবে বেশিরভাগ শহুরে বাড়িগুলোতে ‘মোমপালিশ’ দেয়া লাল ঝকঝকে মসৃণ মেঝে আবার বিত্তবানদের বসার ঘরের মেঝে মোজাইক নতুবা কার্পেট এ দুয়ের একটিতে ঢাকা থাকতো। তবে এখনকার বসারঘর আর তখনকার বসার ঘরগুলো দেখে কোনো বাড়িতে কোন শ্রেণীর লোক বাস করে বা কোন রুচির লোক বাস করে তা আন্দাজ করা যায়। তবে আমার লেখার উদ্দেশ্য হল, বসার ঘর সাজানোর যে উপকরণ সেগুলো সময়ভেদে ও রুচিভেদে এতোই পরিবর্তিত হয়েছে যা ভাবলে বিস্মিত হই। আরও একটি লক্ষণীয় ব্যাপার হল তখন বিত্তবান, মধ্যবিত্ত সব বাড়ির অতিথিদের বসার ঘরেই আপ্যায়নের ব্যবস্থা ছিল, (ভাতের আয়োজন না থাকলে) আর এখনকার দিনে তা ডাইনিং এ করা হয়।