২০০৩ সালের কথা। তখন চট্টগ্রাম সরকারি স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আমি। আমার পশ্চিম বাকলিয়ার বাসা থেকে কলেজ রোডে যাওয়ার রিক্সা ভাড়া ছিল মাত্র ৬ টাকা। দৈনিক স্কুলে যাওয়া–আসার জন্য আম্মুর কাছ থেকে ১৫ টাকা করে পেতাম তখন। সরকারি স্কুলে পড়ার সুবাদে টিফিনের সময় স্কুল থেকেই খাবার পেতাম। তারপরও পকেটে আরো ৩ টাকা বেঁচে থাকত যেটা দিয়ে আইসক্রিম, আচার ইত্যাদি খেতাম তখন।
২০০৪ সালের দিকে এসে রিক্সাভাড়া ৬ টাকার জায়গায় ৭ টাকা হয়ে গেলে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে কারণ ১২ টাকার জায়গায় এখন ১৪ টাকা খরচ হলেও বাসা থেকে তো বাড়তি ২ টাকা নিতে পারব না আইসক্রিম, আচার খাওয়ার জন্য। সুতরাং টিফিনে ৩ টাকার বদলে এখন ১ টাকার আইসক্রিমই খাওয়া লাগবে। কয়েকদিনের মধ্যে এটাকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলার পর মাথায় আরেক নতুন টেনশন ভর করে। পরের বছর যখন রিঙাভাড়া আরো ১ টাকা বেড়ে যাবে, তখন কী করব? হয়ত বাসা থেকে বাড়তি টাকা দেবে কিন্তু আইসক্রিম খাওয়ার টাকাটা তো বাসায় আবদার করতে পারব না। অনেক ভাবনাচিন্তার পর সিদ্ধান্ত নিলাম এখন থেকে আচার আর আইসক্রিম আর খাব না। ঐ ১ টাকাটা এখন থেকে জমাব। এভাবে দীর্ঘদিন কষ্ট করে ৭০ টাকা পর্যন্ত জমিয়েছিলাম। ৭০ টাকা, সেটা ২০০৪ সালে আমার জন্য রীতিমতো স্বপ্নের বিষয়। কিন্তু টাকা হাতে আসার পর যে আরেক নতুন চিন্তায় পড়লাম এবার! এই টাকা রাখব কোথায়? তখন তো ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্টও নেই, মানিব্যাগও ব্যবহার করি না। কী করা যায়? অনেক ভেবে চিন্তে সমাধান বের করলাম। হায়াৎ মামুদের বিখ্যাত একটা বাংলা ব্যাকরণ বই ছিল আমার যেটা সাইজে ছিল অনেক বড়। ঐ বইটার মাঝামাঝি পজিশনে অত্যন্ত নিরাপদ লোকেশনে রাখলাম দীর্ঘ ৩ মাসে জমানো সেই ৭০ টাকা। কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ এড়ানোর জন্য বইটা আরো ৫–৬টা বইয়ের নিচে রাখলাম কিন্তু বিধি বাম, এই সুখও আসলে বেশিদিন স্থায়ী হলো না।
এক বিকেলে পড়ার টেবিলে হঠাৎ আম্মুর আগমন। কী জাদু বলে জানি না, উনার চোখ প্রথমে সেই বইয়ের দিকেই গেল। আসলে বইয়ের মাঝখানে কিছু রাখলে জায়গাটা যে ফুলে থাকে এই বিখ্যাত সূত্রটা তৎকালীন সময়ে কোনো পাঠ্যপুস্তকে পাইনি বিধায় সিস্টেমের চোখকে ফাঁকি দিতে পারলাম না সেই যাত্রায়। যথাযথ ক্লারিফিকেশন দিতে না পারায় সেসময় আম্মু ৭০ টাকা জব্দ করে ফেললেও পরে আসল কথা আদালতে স্বীকার করে টাকাটা পুনরায় পেয়েছিলাম, সাথে ৩০ টাকা বোনাসও মিলেছিল। এখন নিজের টাকায় কতরকম খরচই না করি কিন্তু ১ টাকা করে জমিয়ে ৭০ টাকার পাহাড় জমানোর সেই অনুভূতিটা আর কোনোকিছুতে খুঁজে পাচ্ছি না কিছুতেই। ২০১৭ সালের দিকে পশ্চিম বাকলিয়ার বাসাটা পাল্টে ফেলি আমরা। ব্যস্ততার কারণে সেদিকে তেমন যাওয়াও হয় না। কয়দিন আগে সেদিকে একটা কাজে গিয়েছিলাম। ফিরে আসার সময় একটা রিক্সা ভাড়া করেছিলাম ৭০ টাকা দিয়ে দেবপাহাড় পর্যন্ত। গন্তব্যে পৌঁছে রিক্সাচালককে ভাড়াটা দিতে গিয়ে হঠাৎ চোখ বেয়ে পানি পড়ল আমার। আমার স্কুলের পাশে সেই দেবপাহাড়েই রিক্সা থেকে নেমে ৭ টা দশ টাকার নোট যে একদিন আমার চোখ দিয়ে পানি নামাবে এটা কোনোদিন কল্পনাও করিনি।