করোনার এই বিষণ্ন দিনে বইটি পার্সেল হয়ে এসেছে ঢাকা থেকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজ কবি মনজু আলম পাঠিয়েছেন। প্যাকেট খুলতে ঝলমল করে উঠল স্মৃতি বিজড়িত প্রিয় ক্যাম্পাস। বুকের গহীনে আচমকা শব্দ পেলাম যেন শার্টেল ট্রেনের। সেই সবুজে সেই পাহাড়ের স্মৃতি আমাকে বিশাল সময়ের দূরত্ব ঘুচিয়ে টেনে নিয়ে গেল তরুণবেলায়। ফেলে আসা দিনের কাছে মানুষ ফিরতে পারে না বটে কিন্তু স্মৃতির কাছে ফেরে বার বার। আমরা যারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাদের কাছে বইটির নামটিও অবিশ্বাস্য গুরুত্ব বহন করে। তাছাড়া বইয়ের প্রচ্ছদই আমাদের জানিয়ে দেয় লেখক আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে চান! একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলে লেখকের স্মৃতির সাথে খুব দ্রুত একাত্ম হওয়া যায়। যদিও লেখকের স্মৃতির ভাণ্ডার বিশাল এই ক্যাম্পাস ঘিরে। এই ক্যাম্পাসে তাঁর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন কেটেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে হাত ধরাধরি করে বেড়ে উঠেছেন। কি আছে সেই সবুজে, সেই পাহাড়ে? শোনা যাক লেখকের কাছ থেকে, ‘হৃদয়ে আমার কতশত স্মৃতি গভীর মমতায় ধারণ করে আছি। কত-কত স্মৃতি মনের গভীরে যেন আনন্দ বেদনার কাব্য হয়ে মনের উঠানে ঘুরে বেড়ায় সেইসব স্মৃতি কাতরতায় মন আকুল হয়। স্মৃতি এমন যে কোন আনন্দ-বেদনার পাওয়া না পাওয়ার, পেয়ে হারানোর, হল, ক্লাস, টেলিফোনের গল্প, রুমমেট এবং অনন্য প্রেম-বিরহের গল্প, লেডিস হল, জরুরি হল লিভ, প্রতিপক্ষ গ্রুপের মারামারি, হামিদ ভাইয়ের হাত কাটা, বাপ্পী ভাইয়ের রগ কাটা, শাটল ট্রেন, বোটানিকেল গার্ডেন, ঝর্ণা দেখার গল্প, বিকেলবেলা শহীদ মিনারের আড্ডা, ভার্সিটি মাঠে শেষ বিকেলের গানের আড্ডা, ফরেস্ট্রি হোস্টেলে রাত জেগে ছাদে উঠে আউয়ালের দরাজ গলায় গান শোনা, টেলিফোন এঙচেঞ্জের অপারেটরদের সাথে ও লেডিস হলের দাদুদের সাথে খাতির জমানোর গল্প আরো কত কি কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি?’ এ-সবই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীদের নৈমিত্তিক গল্প। একইরকম অভিজ্ঞতা প্রায় সবার। ছোট ছোট পরিসরে ৪৯টি শিরোনামে লেখক তাঁর স্মৃতির খণ্ডাংশগুলো তুলে ধরেছেন খুব সহজ ও সাবলীল ভাষায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শহরের কোলাহল থেকে প্রায় বাইশ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি অঞ্চলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এক অসাধারণ পরিবেশে। শাটল ট্রেন বহন করে নিয়ে যায় হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসে। শাটল ট্রেনই যেন মান্নাদের ‘কফি হাউস’ গান, আড্ডা, বিজ্ঞতা, বিতর্ক, প্রেম, পাগলামি তারুণ্যের সব উচ্ছ্বাসে ভেসে যায় আসা যাওয়ার এই পথ পরিক্রমায়। ক্লান্তিবিহীন শিক্ষার্থীরা শাটল ট্রেনকেই একটা বিনোদন কেন্দ্র বানিয়ে ছেড়েছিল। তখনও রাজনীতি এতটা কুৎসিত আকার ধারণ করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বয়সে পড়াশোনার বাইরেও অনেক ঘটনায় ঘটে অম্লমধুর এসব কিছুই লেখক সুন্দর ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন।
খুব উপভোগ্য হয়েছে বাবার হোস্টেল ভিজিট, চাঁদনি রাতে ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি, আপা সমাচার, টেলিফোন ও প্রেমের গল্পগুলো।
বিশ্ববিদ্যালয় শেষে এই মোহগ্রস্ত জীবন থেকে বাস্তবতায় ফিরে আসতে হয়। স্বপ্ন ভাঙে স্বপ্ন গড়ে এক সময় জীবনের স্থিতিও আসে। কিন্তু বুকের ভেতর হাতছানি থাকে সেই সময়টার। আবারও লেখকের কথায় ফিরে আসি ‘কিছুই থেমে নেই, জীবন জীবনের মতোই বহমান শুধু আমরা নেই, সেই ধূলিমাখা সোনালি পথে, সেই পাহাড় ঘেরা প্রিয় জনপদ ছেড়ে আজ আমরা অনেক দূরে’ তবুও মন কেমন করে! মন কেমন করে! এ-যেন মান্না দে-র সেই কফি হাউসের মতো। ‘একই সে বাগানে আজ/ এসেছে নতুন কুঁড়ি/ শুধু সেই সেদিনের মালী নেই/ কত স্বপনের রোদ ওঠে এ কফি হাউসে/ কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়/ কতজন এলো গেলো/ কতজন আসবে… ’
লেখক মূলত কবি। এ পর্যন্ত তাঁর পাঁচটি কবিতার বই বের হয়েছে। এটি তাঁর প্রথম গদ্যগ্রন্থ। ১৮ বছরের শিক্ষা জীবনের স্মৃতিচারণ। বইটি পড়ে আবেগতাড়িত হয়েছি। বইটি চবির শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নেবে কিছু সময়ের জন্য। পুরাতনদের তো বটেই, নতুনেরাও মিলিয়ে নেবে অনেক কিছু। স্মৃতি জাগানিয়া বইটি পাঠকদের উপহার দেওয়ার জন্য মনজু আলমকে আন্তরিক সাধুবাদ জানাচ্ছি। আশা করছি পাঠকের কাছে বইটি সমাদৃত হবে। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চাকসুর প্রথম জি. এস. আব্দুর রবসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শহীদদের।