কলকাতার যে অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার খুন হয়েছেন বলা হচ্ছে, তার সেপটিক ট্যাংক থেকে কিছু মাংসের টুকরা উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে পুলিশ। ঢাকার পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বলেন, ভারতে অবস্থানরত ডিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার এ বিষয়ে কথা হয়েছে। সেখানে সঞ্জিভা গার্ডেনসের সেপটিক ট্যাংকের মধ্যে কিছু মাংস পাওয়া গেছে। সেটা সংসদ সদস্য আনারের না অন্য কিছু তা ডিএনএ পরীক্ষা না করে তা নিশ্চিত হওয়া যাবে না। এদিকে ঢাকার তিনটি টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে সঞ্জিভা গার্ডেনসের একজন মালি সিদ্ধেশ্বর মণ্ডল বলছেন, একটি ম্যানহোল চেম্বার থেকে অনেকখানি মাংস উদ্ধার করতে দেখেছেন তিনি। পরিমাণে তা হতে পারে তিন থেকে চার কেজি। হাতের দুই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে তিনি বলছেন, টুকরাগুলো ছোট ছোট, তার ভাষায় ‘পাকোড়া কাট’। খবর বিডিনিউজের।
বাংলানিউজ সূত্রে জানা যায়, ওই সময় আবাসনটিতে স্থানীয় পুলিশ, সফররত বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) টিম ও অন্যরা অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন। সেই সময় ভবন থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসা সিদ্ধেশ্বর মন্ডলের কাছে পরিস্থিতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, হয়ত তাকে খুনের পর কুচি কুচি করে মাংস কমোডে ফ্ল্যাশ করে থাকতে পারে, সেটা পাইপ হয়ে সেপটিক ট্যাংকে গিয়ে দলা হয়েছিল।
এদিকে উদ্ধার হওয়া মাংসের টুকরো ফরেনসিক টেস্টের জন্য আজ বুধবার ল্যাবে পাঠানো হবে। এই মাংস মানুষের বলে প্রমাণ হলে ডিএনএ টেস্টের জন্য ডাকা হবে এমপি আনারের মেয়ে ডরিনকে। তারপরই নিশ্চিতভাবে বলা যাবে সেটি এমপি আনারের মরদেহের খণ্ডিত অংশ কিনা। গতকাল রাতে এমনটাই বলেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশীদ।
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে মূল অপরাধীর কাছ থেকে যে যে তথ্য আমরা পেয়েছি; সেসব তথ্য নিয়েই কলকাতায় এসেছিলাম। আর সে কারণে বাংলাদেশ থেকে এসেই আমাদের প্রথম কাজ ছিল সঞ্জীবা গার্ডেনসের বিইউ ৫৬ নম্বর ফ্ল্যাট পরিদর্শন করা। পরিদর্শনের পরেই আমাদের তদন্তের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি এবং কলকাতা পুলিশকে অনুরোধ করেছিলাম, এই ফ্ল্যাটের কারা প্লাম্বিং এবং বিল্ডিংয়ের কাজটা করেছে তা জানতে। পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি এবং পুলিশ অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের প্রতিটা দাবি–দাওয়া মেনে নিয়েছে।
জিহাদ দেখাল আনারকে তারা কীভাবে খুন করে : বিবিসি বাংলা জানায়, আনার হত্যার ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গে পুলিশের হেফাজতে থাকা জিহাদ হাওলাদারকে দিয়ে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করানো হয়েছে। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ জানতে পেরেছে, আনারের পোশাক, মোবাইল ফোন কোথায় ফেলা হয়েছিল এবং দেহ থেকে খুলি আলাদা করে টুকরা করার পরে কোথায় ফেলে দিয়েছিল হত্যাকারীরা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানিয়েছেন, তাদের সামনেই সোমবার জিহাদ পুক্সখানুপুক্সখ বর্ণনা দেয় কীভাবে হত্যা করা হয় সংসদ সদস্যকে। তার কথায়, পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি তাকে সোমবার ঘটনার পুনর্নির্মাণের জন্য ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়েছিল, আমরাও সেখানে ছিলাম। ওই ফ্ল্যাটে যখন ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিচ্ছিল জিহাদ, তার সঙ্গে ঢাকায় ধৃত আমানুল্লাহসহ অন্যদের বয়ানে কিছু অসঙ্গতি পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকেই একাধিকবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকা ও কলকাতায় ধৃতদের মুখোমুখি জেরাও করা হয়।
সোমবার সিআইডির গোয়েন্দা এবং ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তার সামনে জিহাদ বর্ণনা দেয় কীভাবে তারা আনোয়ারুল আজীমকে এই ভবনের এক ফ্ল্যাটে হত্যা করে লাশ গুম করেছিল। এর আগে রোববার কলকাতায় এসে সন্ধ্যা থেকে বেশ কয়েক ঘণ্টা পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির হেফাজতে থাকা অন্যতম অভিযুক্ত জিহাদকে নিজে জেরা করেন ঢাকার গোয়েন্দারা। জিহাদকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সদর দফতর ভবানী ভবনে রাখা হয়েছে, সেখানেই চলে এই জেরা। তার আগে ঢাকার গোয়েন্দারা গিয়েছিলেন নিউ টাউনের সেই ফ্ল্যাটে, যেখানে হত্যা করা হয় আনারকে। দুই জায়গা থেকেই একাধিকবার ঢাকায় গ্রেপ্তারদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেন হারুন।
ঘটনার পুনর্নির্মাণে যা জানা গেল : জিহাদ বিবরণে জানা যায়, ১৩ মে দুপুর তিনটার দিকে দুই অভিযুক্ত ফয়সাল এবং আমানুল্লাহর সঙ্গে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন সংসদ সদস্য। ওই ফ্ল্যাটটি ডুপ্লেক্স, অর্থাৎ ফ্ল্যাট হলেও তার ভেতরেই দুটি তলা রয়েছে। দুই অভিযুক্ত আজীমকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢোকার সময়ে তৃতীয় অভিযুক্ত সেলেস্তি রহমান উপরের তলায় ছিল আর নিচের অংশের ভেতরের একটি ঘরে ছিল জিহাদ ও সিয়াম। জিহাদ পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির হাতে ধরা পড়লেও সিয়াম পলাতক। তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, সে সম্ভবত নেপালে পালিয়েছে।
জিহাদের বর্ণনা অনুযায়ী, ফ্ল্যাটে প্রবেশের পর ক্লোরোফরম ভেজানো কাপড় আজীমের মুখে চেপে ধরা হয় এবং তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয় ফ্ল্যাটের রান্নাঘর সংলগ্ন জায়গায়।
সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, ফ্ল্যাটের যে হলঘর, অর্থাৎ বসার ও খাওয়ার জায়গা, সেখানে একটি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। সেটি খুনের আগে, ৭ মে দুপুর নাগাদ সেলেস্তি রহমান কাপড় আর লিউকোপ্লাস্ট দিয়ে ঢেকে দেয়। সেই সিসিটিভির ফুটেজ কার কাছে আছে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
দেহ লোপাটের ব্যবস্থা : খুনের পরে কীভাবে দেহ লোপাট হবে তাও আগে থেকে ঠিক করা ছিল বলে গ্রেপ্তারকৃতরা আগে ঢাকা এবং পশ্চিমবঙ্গ পুলিশকে জানিয়েছিল। সোমবার জিহাদ পুলিশের কাছে যে বর্ণনা দিয়েছে তাতে জানা যায়, রান্নাঘর সংলগ্ন জায়গায় হত্যা করার পর জিহাদ আনারের দেহ থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নেয় এবং হাড়–মাংস পৃথক করে ফেলে। শরীর থেকে কেটে ফেলা হয় মাথা। দেহের মাংস ও খুলি টুকরা করে জিহাদ। এই কাজে সে চপার জাতীয় ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেছিল বলে সিআইডিকে জানিয়েছে। ওই অস্ত্র স্থানীয়ভাবে কিনে এনেছিল আমানুল্লা। দেহের টুকরাগুলি ছোট ছোট প্যাকেটে ভরা হয়।
প্রমাণ লোপাটের জন্য আরেকটি কাজ করেছিল হত্যাকারীরা। সোমবার জিহাদের দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী, ফ্ল্যাটে ঢোকার আগে তিনজনই বাইরে জুতা রাখার ক্যাবিনেটে নিজেদের জুতা খুলে প্রবেশ করেছিল।
আনারের পোশাক কোথায় গেল : সিআইডির এক অফিসার বলেন, জিহাদ জানিয়েছে, আনারের টুকরা করা দেহাংশ ভর্তি প্যাকেটগুলো নিয়ে রওনা হয় ভাঙ্গরের কৃষ্ণমাটি সেতুর দিকে। তার সঙ্গে ছিল দেহ টুকরা করার অস্ত্র এবং আনারের পোশাক ও মোবাইল। মোবাইল ও পোশাক ফেলে দেয় নিউ টাউন থেকে কৃষ্ণমাটি সেতুর দিকে যাওয়ার পথে গাবতলা বাজার নামে একটি জায়গায়। সেখানেও বাগজোলা খালই বইছে।
সিআইডি এবং ঢাকার ডিবি প্রধানের সামনে জিহাদ জানিয়েছে, সেখান থেকে আরও এগিয়ে গিয়ে কৃষ্ণমাটি সেতুর কাছে একটি বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে নিচে নেমে দেহাংশ ভরা প্যাকেটগুলো খালের জলে ফেলে দেয় সে। সঙ্গে দেহ টুকরা করার কাজে ব্যবহৃত চপারটিও। ওই জায়গাতেই তিন দিন ধরে ডুবুরি ও নৌকা নামিয়ে তল্লাশি চালায় সিআইডি।
খুলির টুকরা নিয়ে অন্য পথে ফয়সাল : জিহাদ যখন দেহাংশের টুকরা, অস্ত্র, মোবাইল এবং পোশাক নিয়ে ভাঙ্গরের দিকে রওনা হলো, তখন অন্য একটি রাস্তা ধরে আরেক অভিযুক্ত ফয়সাল মাথার খুলির টুকরোগুলো নিয়ে উত্তর ২৪ পরগনার দিকে রওনা হয়েছিল, এমনটাই জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা। তারা জেনেছেন, উত্তর ২৪ পরগনার শাসন অঞ্চলে মাথার খুলির টুকরোগুলো ফেলে দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ মোট তিনটি জায়গায় আলাদাভাবে দেহ লোপাট করা হয়েছে, সরিয়ে ফেলা হয়েছে অন্যান্য প্রমাণও।
এছাড়া আনারের ভারতীয় মোবাইলটি নিয়ে বিহার হয়ে নেপালের পথে রওনা হয়েছিল আরেক অভিযুক্ত সিয়াম। সেই সিমটি কয়েকবার অ্যাক্টিভেটও করেছিল সে এবং সেখান থেকে কলকাতায় আনারের বন্ধু গোপাল বিশ্বাসকে কয়েকবার মেসেজ পাঠায়, বাংলাদেশেও এমপির সহকারীর কাছে ফোন করে একবার।
চরমপন্থি শিমুল ভুঁইয়ার সহযোগী আটক : সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যায় যশোর থেকে আরও একজনকে আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। গতকাল রাতে যশোর শহরের চাঁচড়া বাবলাতলার একটি মৎস্য হ্যাচারি থেকে সাইফুল আলম মোল্লা মেম্বার নামে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে বলে ডিবি পুলিশের এসআই মো. মফিজুল ইসলাম জানান। তিনি শিমুল ভুঁইয়ার সেকেন্ড ইন কমান্ড এবং পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। তিনি অভয়নগর উপজেলার দত্তগাতি গ্রামের কাশেম মোল্লার ছেলে।