গার্মেন্টস কর্মী কোহিনূর, ছিন্নমূলের খেটে খাওয়া মিনু। দু’জনের একজনও বেঁচে নেই। নৃশংসতা ও করুণ পরিণতির শিকার হতে হয়েছে দুজনকে। যার জন্য এতো ঘটন অঘটন, সেই মানুষটিই লাপাত্তা। হন্নে হয়ে খোঁজেও তার হদিস পাচ্ছে না পুলিশ। রহমতগঞ্জসহ সম্ভাব্য এলাকায় দেখা নেই পর্দার আড়ালের সেই কুলসুম আক্তারের। অথচ গত ৭ জুন তাকে গ্রেপ্তারে উচ্চ আদালত নির্দেশ দেন। মোবাইল ফোনে কথা বলাকে কেন্দ্র করে ২০০৬ সালের ২৯ মে নগরীর রহমতগঞ্জে কোহিনূর আক্তার প্রকাশ বেবি (২২) নামের এক গার্মেন্টস কর্মীকে শ্বাসরোধ ও গলা টিপে হত্যা করে কুলসুম আক্তার। এরপর তার লাশ বাড়ির পেছনে আঁতা গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। প্রচারণা চালানো হয় কোহিনূর আত্মহত্যা করেছেন। এ ঘটনায় প্রথমে একটি অপমৃত্যু মামলা হলেও পরে কোতোয়ালী থানার তৎকালিন এসআই ইকরাম হোসেন একটি হত্যা মামলা করেন। মামলার এজহারসূত্রে জানা যায়, কোহিনূর ছিলেন আনোয়ারার বাসিন্দা। ঘটনার কয়েক বছর আগে একই এলাকার জমির আলীর সাথে তার বিয়ে হয়। এক বছর যেতে না যেতেই তার ওপর শুরু হয় স্বামীর নির্যাতন।
এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে রহমতগঞ্জের বাংলা কলেজের পাশের আবছার উদ্দিনের বিল্ডিংয়ে কুলসুমের বাসায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় কোহিনূর। চেরাগী মোড়ের এ্যাপোলো গার্মেন্টসে চাকরি নেন। ঘটনার সময় স্বামীর সাথেই ফোনে কথা বলছিলেন কোহিনূর। বিষয়টি মানতে না পেরে ভারি অস্ত্র দিয়ে কোহিনূরের মাথায় আঘাত করে বসে কুলসুম। এক পর্যায়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে গলা টিপে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। কুলসুম লোহাগাড়ার আহাম্মদ মিয়ার বাড়ির আনু মিয়ার সন্তান। রহমতগঞ্জের ওই বাসায় স্বামী ছালে আহমদসহ বসবাস করতেন।
আদালত সূত্র জানায়, দুই বছর তদন্ত করে কোহিনূর খুনে কুলসুমকে দায়ী করে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। আদালত সেই চার্জশিট আমলে নিয়ে কুলসুমের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। ২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রয়োজনীয় সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক কার্যক্রম শেষ করে তৎকালীন অতিরিক্ত ৪র্থ মহানগর দায়রা জজ আদালত কুলসুমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরো ১ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ এবং তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোনা জারি করেন।
আদালত সূত্র আরো জানায়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও গ্রেপ্তারি পরোনা জারির পর কুলসুম ২০১৮ সালের ১২ জুন কৌশলে তার জায়গায় মর্জিনা নামের একজনের মাধ্যমে মিনু নামের একজনকে আদালতে উপস্থাপন করে। তার নির্দেশ মতে মিনু আদালতে নিজেকে কুলসুম দাবি করলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সেই থেকে গত ১৬ জুন পর্যন্ত মিনু কোনো রকম অপরাধ না করেও প্রলোভনে পড়ে জেল খাটেন। সূত্র জানায়, কোহিনুরকে হত্যার পরের বছর অর্থাৎ ২০০৭ সালের ২৬ অক্টোবরই কুলসুম আক্তারকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছিল পুলিশ। কারাগারে প্রায় ১ বছর ৩ মাস ছিলেনও তিনি। পরে ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তার জামিন হয়।
এদিকে কুলসুম এখনো গ্রেপ্তার নেই কেন এমন প্রশ্ন তুলেছেন ভুক্তভোগী মিনুর আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ। এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানার ওসি নেজাম উদ্দিন বলেন, কুলসুমকে গ্রেপ্তারে রহমতগঞ্জে অভিযান চালানো হয়েছে। তাকে সেখানে পাওয়া যায়নি। আমরা গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখছি। আশা করছি, শীঘ্রই তাকে পেয়ে যাব।
উল্লেখ্য, কোহিনূর হত্যা মামলায় কুলসুমের হয়ে তিন বছর জেল খেটে উচ্চ আদালতের নির্দেশে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে গত ১৬ জুন মুক্তি পান কুমিল্লার ময়নামতি এলাকার বাসিন্দা মিনু। এরপর ১ ছেলেসহ বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড এলাকায় থাকা ছোট ভাইয়ের বাসায় (ছিন্নমূল) গিয়ে উঠেন। এর ১২ দিন পর ২৯ জুন বাসা থেকে প্রায় দেড় দুই কিলোমিটার দূরে লিংক রোডে দ্রুতগতির ট্রাক চাপায় মৃত্যু হয় মিনুর। তারও আগে কারাগারে থাকা অবস্থায় তিন সন্তানের একজনকে (জান্নাত) হারান মিনু। এছাড়া গত কয়েকদিন ধরে তার বড় ছেলে ইয়াছিনকেও খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানায় মিনুর ভাই রুবেল। বিনা অপরাধে মিনুর জেল খাটার বিষয়টি গত ৩১ মার্চ জনস্বার্থে উচ্চ আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। তারও আগে চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ মারফত লোমহর্ষক এ ঘটনা জানাজানি হয়।