সে এক অমরকাব্য

রেজাউল করিম | বুধবার , ৩ মার্চ, ২০২১ at ১১:৩০ পূর্বাহ্ণ

অগ্নিঝরা মার্চ বাঙালির স্বপ্নসাধ যৌক্তিক পরিণতির মাস। বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম ঘটনা হচ্ছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এই ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক-রাজনৈতিক স্বপ্নসাধ পূরণ হয়। ১৯৭১ সালে এসে যে রাজনৈতিক সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করে যদিও তার গোড়াপত্তন হয়েছিল বহু বছর আগে। পরে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র শিক্ষা আন্দোলন এবং ’৬৯’র গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের মার্চে এসে বাঙালির সেই স্বপ্নসাধ যৌক্তিক পরিণতিকে স্পর্শ করে।
প্রত্যেক বাঙালির হৃদয়ের গহীনে লালন করা তখনো অধরা ‘স্বাধীনতা’ যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ‘তুমি যে সুরের আগুন ছড়িয়ে দিলে, মোর প্রাণে সেই আগুন ছড়িয়ে গেলো সবখানে, সবখানে’, কবিগুরুর মতো বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি শুধুই বাঙালিদের।
কিন্তু এই স্বাধীনতা একদিনে আসেনি। পটভূমি তৈরি করতে সময় লেগেছে। সেই পটভূমি তৈরি করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাঁর দুই যুগের আন্দেলন ও সংগ্রামের ফল, তাঁকে বাঙালি জাতির জনক, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা-পিতা হিসেবে আবির্ভূত। শেখ মুজিবের বিপ্লব শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা বিপ্লব নয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক নেতা বিভিন্ন সময়ে আবির্ভূত হয়েছেন, কিন্তু তাদের কেউই আমজনতার হৃদয় নিংড়াতে পারেননি।
১৯৯২ সাল থেকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য সম্পদের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে আসছে। এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বকোভার কথায়, ‘আমি গভীর ও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দালিলিক ঐতিহ্য ও স্মৃতি সংরক্ষণে এ কর্মসূচি পরিচালিত হওয়া উচিত, যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সংলাপ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শান্তির চেতনা লালন করতে পারে।’ যুদ্ধবিগ্রহ, লুণ্ঠন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন ইত্যাদি কারণে দেশে-দেশে বিশ্ব ঐতিহ্য বিনষ্ট বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। আবার সম্পদের অপ্রতুলতার কারণেও যথাযথভাবে তা সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণেও তা বিনষ্ট বা বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। এসব দিক বিবেচনায় ইউনেস্কোর এ কর্মসূচির গুরুত্ব অপরিসীম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি পৃথিবীর একাধিক ভাষায় ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবীর কোনো দেশে কোনো নেতার ভাষণ সেদেশের মানুষ শ্রবণ করে আসছে কিনা সন্দেহ। এটি এমনই ব্যঞ্জনাপূর্ণ ও গীতিময় যে, যতবার শ্রবণ করা হয়, ততবারই মনে হবে এই প্রথমবার শোনা হল, কখনও পুরনো মনে হয় না। এই ভাষণ একটি জাতি-জনগোষ্ঠীর মুক্তির কালজয়ী সৃষ্টি, এক মহাকাব্য। বহুমাত্রিকতায় তা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। শুধু বাঙালির জন্যই নয়, বিশ্বমানবতার জন্যও অবিস্মরণীয়, অনুকরণীয় এক মহামূল্যবান দলিল বা সম্পদ।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি কেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণগুলোর অন্যতম হিসেবে অভিহিত? এর উত্তরে সংক্ষেপে যা বলা যায় তা হল- যে কোনো শ্রেষ্ঠ ভাষণমাত্রই প্রচণ্ড উদ্দীপনাময়, মুহূর্তে মানুষকে নবচেতনায় জাগিয়ে তুলে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত করতে পারঙ্গম। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে নজিরবিহীনভাবে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। ‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/ রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অত:পর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/ হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার/ সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’/ সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’ ভাষণে দৃপ্তকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমরা ভাতে মারবো। আমরা পানিতে মারবো … আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। … রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ।’ ঠিকই, কোনোরূপ আপসকামিতার পথে না গিয়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে ৩০ লাখ লোক আত্মোৎসর্গ করেন, যা বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন। শ্রেষ্ঠ ভাষণের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নেতৃত্বের সর্বোচ্চ দেশাত্মবাধ, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির এবং লক্ষ্য অর্জনে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মূল ও আশু লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ-নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা। শ্রেষ্ঠ ভাষণের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সময়ের পরিসীমায় গণ্ডিবদ্ধ না থেকে তা হয় কালোত্তীর্ণ ও প্রেরণাদায়ী। ইতিহাসখ্যাত শ্রেষ্ঠ ভাষণের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এর কাব্যিক গুণ- শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাসে যা হয়ে ওঠে গীতিময় ও শ্রবণে চতুর্দিকে অনুরণিত। ৭ মার্চের ভাষণটি ঠিক অনুরূপ, যে কারণে বঙ্গবন্ধু আখ্যায়িত হন পয়েট অব পলিটিঙ বা রাজনীতির কবি। যে কোনো শ্রেষ্ঠ ভাষণই উত্থিত হয় বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে, ফলে তাকে তাৎক্ষণিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও হৃদয় উৎসারিত বলা যায়। ৭ মার্চের ভাষণও ছিল তা-ই, যা লিখিত ছিল না। বিশ্বমানবতার মুক্তির সংগ্রামে যুগে যুগে এ ভাষণ অনুপ্রেরণা যোগাবে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও মুজিববর্ষে ৭ মার্চ বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে নি:সন্দেহে। কেননা আমরা স্বল্পোন্নত থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশে পৌঁছেছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকেশুয়া আমার প্রাণ
পরবর্তী নিবন্ধমগধরা ইউনিয়নে মতবিনিময় সভা