সুস্থ সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে স্কাউট আন্দোলন জোরদার করা জরুরি

জিয়া হাবীব আহসান | সোমবার , ৭ এপ্রিল, ২০২৫ at ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ

প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, ‘সাহসী ও দায়িত্বশীল আগামীর প্রজন্ম’। এর আলোকে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করতে সারা দেশের প্রতিটি শাখাকে বাংলাদেশ স্কাউটস সদর দপ্তর আহ্বান জানিয়েছে।

বিশ্বব্যাপী স্কাউটিং একটি সামাজিক আন্দোলনের নাম। বিশ্বের প্রায় ১৬১ টি দেশে তিন কোটিরও বেশি সদস্য স্কাউট আন্দোলনের সাথে জড়িত। বাংলাদেশ বিশ্ব স্কাউট সংস্থার ১০৫ তম সদস্য। বর্তমানে বাংলাদেশে স্কাউট সদস্যের সংখ্যা প্রায় ২৩ লক্ষ। সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশ স্কাউটের অবস্থান বিশ্বে ৫ম (পঞ্চম)। নৈতিক অবক্ষয় রোধ, সৃষ্টির সেবার মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন, সমাজ থেকে বৈষম্য দূরীকরণ ও একটি আত্মপ্রত্যয়ী দেশ গঠনে স্কাউটিং এর ভূমিকা অপরিসীম। ১৯০৭ সালে লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল ব্রাউনসি দ্বীপে মাত্র ২০ জন বালক নিয়ে প্রথম স্কাউট ক্যাম্প এর মধ্য দিয়ে স্কাউটিং এর যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তীতে মেয়েদের জন্য ১৯১০ সালে, কাবদের জন্য ১৯১৪ সালে এবং রোভারদের জন্য ১৯১৮ সালে শাখা ভিত্তিক স্কাউটিং এর প্রবর্তন করা হয়। শিশু কিশোর ও তরুণদের মধ্যে নানা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবিক গুনাবলীর বিকাশে দক্ষতা অর্জনপূর্বক একটি সৌভাতৃত্বপূর্ণ বৈষম্যমুক্ত মানবিক সমাজ গঠনে স্কাউটিং এর জুড়ি (তুলনা) নেই।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের প্রথম ব্যাচ এর সর্ব্বোচ পদক ‘প্রেসিডেন্ট স্কাউট’ বা রাষ্ট্রপতি সনদ (পদক) প্রাপ্ত স্কাউট লীডার হিসাবে আমার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি বর্তমান সময়ে প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে স্কাউট আন্দোলনকে জোরদার করার স্বপক্ষে জোরালো মত প্রকাশ করছি। একটি মাদকমুক্ত সমাজ গঠন, সামাজিক অস্থিরতা, কিশোরগ্যাং, হিংসা, বিদ্বেষ, বৈষম্য ও নৈতিক অবক্ষয় রোধে স্কাউট তারুন্যকে জাগিয়ে তোলার একটি মোক্ষম অস্ত্র বা ম্যাজিক বলে মনে করি। স্কাউটিংকে বলা হয় ‘ট্যোট্যালএডুকেশন ফর লাইফ’, যাকে ‘একের ভিতরে সব’ও বলা হয়। কারণ এর মধ্যে রয়েছে খেলাধুলা, প্রযুক্তি বিদ্যা, আত্মরক্ষার কৌশল, সংস্কৃতির চর্চা, প্রাথমিক প্রতিবিধান (ফাস্ট এইড), শরীর চর্চা, ধর্মচর্চা, ব্লাড ব্যাংক, সমাজ সেবা, বৃৃক্ষরোপন, বাগান করা, মাছ চাষ, অগ্নি নির্বাপণ, পশুপালন, পাখিপালন, পরিভ্রমণ, তাবুঁবাসী, তাঁবু জলসা, পাইওনিয়ার প্রজেক্ট তৈরী, বেসামরিক প্রতিরক্ষা, হাইকিং, ট্রেকিং, কমিউনিটি পুলিশিংসহ নেতৃত্ব গঠনমূলক প্রভৃতি নানামুখী কার্যক্রম। স্কাউটিং এর তিনটি শাখা যথাক্রমে কাব (প্রাথমিক বিদ্যালয় স্কাউটিং), স্কাউট ও রোভার। স্কাউটিংএপ্রতিটি কাজ হাতে কলমে শিক্ষা দেয়া হয়। এর ৭৫ ভাগ কাজ হচ্ছে মুক্তাঙ্গন ভিত্তিক। উপদল পদ্ধতিতে ছোট ছোট ভাগ করে ৮ জনের প্রতিটি উপদল এএকজনকে লিডার বানানো হয়। দক্ষতা ও পারদর্শিতা দুই প্রকারের ব্যাজ পদ্ধতির মাধ্যমে সদস্যদের ‘শাপলা কাব অ্যাওয়ার্ড’ অর্জনে উৎসাহিত করা হয়। কাব ও স্কাউটরা যে কক্ষে বসে নিয়মিত কাজ পরিচালনা করে তাকে ‘স্কাউট ডেন’ বলা হয়। প্যাক মিটিং এর মাধ্যমে স্কাউট প্রোগ্রামগুলো প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়। এতে সেবারমাধ্যমে আত্মোন্নয়ন ঘটানো হয়। স্কাউট আন্দোলনের তিনটি মূলনীতি ) ডিউটি ট ুক্রিয়টর (স্রষ্টার প্রতি দায়িত্ব), ) ডিউডি টু সেলফ (নিজের প্রতি দায়িত্ব) ও ৩) ডিউটি টু আর্দাস (সমাজের প্রতি দায়িত্ব)। স্কাউটকে অপরের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। স্কাউটদের স্লোগান হলো ‘প্রতিদিন কারো না কারো উপকার করা’। এটা হতে পারে খুবই ছোট কাজ। যেমন, রাস্তা থেকে একটা কলার খোসা সরিয়ে ফেলা, একজন অন্ধকে রাস্তা পার করিয়ে দেয়া, তৃঞ্চার্থকে পানি পান করানো ইত্যাদি। কাবদের মটো হচ্ছে ‘যথাসাধ্য চেষ্টা করা’। স্কাউটের লক্ষ্য হচ্ছে আমি আমার আত্মমযার্দার ওপর নির্ভর করে প্রতিজ্ঞা করছি যে, . আমি আমার স্রষ্টা ও দেশের প্রতি কর্তব্য পালন করতে; . সর্বদা অপরকে সাহায্য করতে; . স্কাউট আইন মেনে চলতে আমি আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। স্কাউট আইন সাতটি: .স্কাউট আত্মমর্যাদায় বিশ্বাসী, . স্কাউট সকলের বন্ধু, . স্কাউট বিনয়ী ও অনুগত, . স্কাউট জীবের প্রতি সদয়, .স্কাউট সদা প্রফুল্ল, . স্কাউট মিতব্যয়ী, . স্কাউট চিন্তা, কথা ও কাজে নির্মল। স্কাউটের মূলমন্ত্র : ‘সদাপ্রস্তুত’। স্কাউট শপথ হচ্ছেআমি সর্বদা আল্লাহ্‌ ও আমার দেশের প্রতি কর্তব্য পালন করতে এবং স্কাউট এর ১০টি আইন মেনে চলতে যথা সাধ্য চেষ্টা করবো। আমি নিজেও ছাত্র জীবনে একজন পেট্রোল লিডার ও ট্রুপলিডার হিসাবে বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করি।

বাংলাদেশে ১৯৭৮ সালে ঢাকার গাজীপুর মৌচাকে ৮দিন ব্যাপী (২১২৯ জানুয়ারী) অনুষ্ঠিত প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় স্কাউট ওয়ার্ল্ড জাম্বুরীতে অংশগ্রহণ করি। এতে সারা দেশ ও বিশ্বেও বিভিন্ন অংশগ্রহণকারী স্কাউটদের সাথে ভাববিনিময়, অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং বন্ধুত্ব হয়। দেশের প্রধান স্কাউট রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সাথে দীর্ঘ ১১ মাইল ম্যারাথন/ওর্য়াকথন এ অংশগ্রহণ করি। স্কাউটিং একটি অহিংস অসাম্প্রদায়িক অরাজনৈতিক প্লাটফর্ম, যার মাধ্যমে দেশ ও জাতি গঠনের সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সুপথে পরিচালিত হয় এবং তাদের মধ্যে মহান প্রভু, পিতামাতা শিক্ষকের প্রতি আনুগত্য সৃষ্টি হয় বিধায় তারা কখনো বিপথগামী হয় না বিগত ০৭.০৫.১৯৮২ ইং তারিখে আমার অর্জিত রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত (২৫/৮০)নং প্রেসিডেন্ট এওয়ার্ড সার্টিফিকেটে লিখা আছে, ‘প্রেসিডেন্ট স্কাউট হিসাবে তুমি মহান আল্লাহ ও অপরের খেদমতের জন্য তৈরী হয়েছ এবং স্কাউট ভ্রাতৃত্বের সদস্য হিসাবে যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছ। শক্তি ও সাহস সঞ্চয়ে এবং দেশের খেদমতে নিজেকে হাজির করতে আল্লাহ তোমাকে তৌফিক দিন।’ “আমিন” (স্বাক্ষর) চীফ স্কাউট আহসান উদ্দিন চৌধুরী (রাষ্ট্রপতি)। এ সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য আমাকে আরো কতিপয় প্রফিসিয়েন্সী ব্যাজ (সার্টিফিকেট) অর্জন করতে হয়। যেমনঅগ্নি নির্বাপক, পাখীপালক, সমাজ উন্নয়ন, কর্মকৌশল, প্রাথমিক প্রতিবিধানকারী, হাসপাতাল কর্মী, তাঁবুবাসী, পথ প্রর্দশক, বুশম্যান থং, অগ্রগামী আহতের শুশ্রসাকারী, সৎ প্রতিবেশী, পৌরবিজ্ঞানী, তাঁবুবাসী ইত্যাদি।

বাংলাদেশ স্কাউটস একটি জাতীয় ধরণের প্রতিষ্ঠান হলেও এটি একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলনের অংশ। স্কাউট বলতে এক কথায় কাবস্‌ স্কাউট, বয়স্কাউট, রোভার স্কাউট ও সীস্কাউট প্রভৃতিকে বুঝায়। বাংলাদেশ স্কাউট সংগঠিত হয়েছে রাষ্ট্রপতির ফরমান দ্বারা। বর্তমানে বাংলাদেশ স্কাউটস এর পক্ষে থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চল সহ সারাদেশে স্কাউট আন্দোলনকে জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

আন্দোলনকে ভবিষ্যতে সকল প্রকার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত রাখতে বর্তমান জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা স্কাউট এবং এডহক কমিটিগুলো আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এমুহূর্তে আমি একজন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট স্কাউটলিডার চট্টগ্রাম আঞ্চলিক স্কাউটস এর সহসভাপতি হিসাবে আশা করছি প্রচুর সংখ্যক ওপেন ট্রুপ খুলে স্কাউট প্রোগ্রাম সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া আবশ্যক। পাড়ায়পাড়ায়, মহল্লায়, মহল্লায় স্কাউটট্রুপ খুলতে পারলে স্কুলের শিক্ষার্থীরা নিজ পাড়া মহল্লায় বসে স্কাউটিং করতে পারবে, ইনশাল্লাহ।একাজের জন্য প্রচুর স্কাউট লিডার সৃষ্টি করা দরকার। উদ্যোমী লোকদেরকে ট্রেনিং দিয়ে এ আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেয়ার উদাও আহ্বান জানাচ্ছি। বয়স্কাউট সৃষ্টি করতে হলে রোভার স্কাউট বৃদ্ধি করতে হবে। প্রত্যেক স্কুলের পি.টি টিচারকে স্কাউটিং এর প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ছাত্রীদের জন্যও গার্লস গাইড আন্দোলন জোরদার করা অত্যন্ত জরুরি, এতে সামাজিক বৈষম্য দূর হয় এবং এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা কেটে যায়, বেকারত্ন ঘুছে যায়, উদ্যোক্তা হওয়ার যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। হতাশা আত্মহত্যা প্রবণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ আর আত্মনির্ভরশীল হতাশামুক্ত উন্নত নৈতিক জীবন গঠনে স্কাউটিং আলোর মশাল জ্বালাতে পারে। আশা রাখি সরকার এব্যাপারে বাজেটে বিশেষ বরাদ্ধের ব্যবস্থা রাখবে, যাতে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গ্রামে গ্রামে এ আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেয়া যায়।

লেখক : আইনবিদ, রাষ্ট্রপতি পদকপ্রাপ্ত একজন স্কাউট লিডার, সহসভাপতি চট্টগ্রাম আঞ্চলিক স্কাউটস ও মহাসচিব, বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটাস ফাউন্ডেশনবিএইচআরএফ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলা আমার
পরবর্তী নিবন্ধসেলসম্যানশিপ এবং এআই সঙ্কুল সময়