সুশিক্ষিত জাতি আর স্বশিক্ষিত জাতি

অস্মিতা তালুকদার | সোমবার , ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ১০:৩০ পূর্বাহ্ণ

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় একটা শিশু যখন কথা বলতে শুরু করে তাকে শিশু শ্রেণি অর্থাৎ প্লে থেকে শিক্ষাগ্রহণ শুরু হয়। এরপর নার্সারি, কেজি। সেখানে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, সংখ্যাগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে হাতেখড়ি দেওয়া হয়। এরপর প্রথম শ্রেণিতে যখন উত্তীর্ণ হয় পাঠ্যবইতে দেশ, বিভাগ জেলা, ইউনিয়ন, আয়তন এসব বইতে সংযোজন করা আছে। এসবের অর্থ তারা এই বয়সে এসে কীই বা বুঝবে? বিসিএস পরীক্ষা দিবে? যেখানে তাদের পাঠ্যক্রমে জোর দেওয়া উচিত ব্যবহারবিধি ও আচরণীয় কর্মকাণ্ডের উপর। শিশুকে জন্মের পর থেকে তার পরিবার থেকে ব্যবহার, আচরণ শেখানো শুরু হয় কিন্তু বিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানের সাথে যখনই তার পরিচয় করানো হয়, তাকে উপলব্ধি করানো হয় এ জায়গা শুধু শেখার জায়গা, যেখানে জ্ঞান নামক বিশাল জগতের সাথে আমাদের কেবল পড়া মুখস্থ করার যাত্রা শুরু হচ্ছে! দুঃখজনক ভাবে এ জ্ঞান শুধু তথাকথিত মেধাবী যারা পরীক্ষায় ভালো নম্বর আনতে প্রস্তুত, জগত তাদেরই সমাদর করে থাকে! এই রুঢ় বাস্তবতার সম্মুখীন যখন একজন শিক্ষার্থী হয় তার সেই কোমলমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, এবং খুব দ্রুতই পড়াশোনাকে তার কাছে ভীতিকর, বোঝাস্বরূপ মনে হয় এবং বিদ্যাপীঠকে শৃংখলাবদ্ধ কারাগারের মত মনে হয়! আসলেই বিদ্যালয়ের শাব্দিক অর্থ তাই বুঝিয়েছিল?

এবার আসি মূল কথায়, যে বয়সে বিদ্যালয়ে যাত্রা শুরু হয় ৪ কিংবা ৫ বছর সে বয়সে শিক্ষার্থী আচার ব্যবহারই ঠিকমতো রপ্ত করতে পারে না সে বয়সে কেন এসব মানসিক চাপযুক্ত মুখস্থবিদ্যার বিশাল সিলেবাসের পড়াশোনা শুরু হবে? এ বয়সে একজন শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ পরিপক্ক করার সময়, তাকে তথাকথিত পড়াশোনার চাপ কমিয়ে যদি মূল্যবোধ মূল্যায়ন করা হতো তাহলে ভবিষ্যতে জাতি অন্যরকম হতে পারতো। এ মূল্যায়নের কয়েকটি ধাপ যুক্ত হতে পারে, যেমন ভালো কাজ‘ (সহপাঠী কিংবা অন্য কেউ ব্যথা পেলে না হেসে তাকে সহযোগিতা করা, কারও সাথে রাবার, পেন্সিল দিয়ে সাহায্য করা ইত্যাদি), ‘ভালো ব্যবহার’(যেমন সহপাঠী কিংবা অন্যদের সাথে ভদ্রতা বজায় রেখে সুন্দরভাবে কথা বলা, মারামারি না করা ইত্যাদি), ভালো আচরণ (যেমন অন্যের জিনিসপত্র না বলে স্পর্শ করা, সত্যবাদিতা, উপকারিতা) ইত্যাদি আচরণ যদি দৈনন্দিন পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তা যদি দৈনন্দিন মূল্যায়ন করা হয় তাহলে শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট ভালো কাজগুলোতে তারা উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হবে, পাশাপাশি প্রতিদিন যদি এসব মূল্যায়নে নম্বর সংযোজন করা হয় তবে শিক্ষার্থী মূল্যবোধ আচরণে সক্রিয় হবে।

একজন শিশুর মানসিক পরিপক্কতা আসে ৯ বছর বয়স থেকে। এর আগে প্রাক প্রাথমিক পর্যায় থেকে যদি শিক্ষাগ্রহণে পরীক্ষা পদ্ধতি শুধু মুখস্থবিদ্যায় সীমাবদ্ধ এবং এতে পাশ করতেই হবে এ বিষয় মস্তিষ্কে সন্নিবেশ করে দেওয়া হচ্ছে যেটাতে তারা যেভাবেই হোক পরীক্ষাতে পাশ করতে হবে, সহপাঠীদের মধ্যে অন্যতম হওয়ার নিষ্ঠুর চর্চা নিষ্পাপ শিশুর মনে গেঁথে যাচ্ছে, যা একসময় অতি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি পরীক্ষা পদ্ধতি ভালো আচরণ তথা মূল্যবোধের উপর হয়, আর সে বিষয়ে যদি শিক্ষার্থীকে উদ্ধুদ্ধ করা হয় তাহলে কালক্রমে এক মানবিক জাতি গড়ে তুলতে সক্ষম হব।

আদৌ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা সুশিক্ষিত জাতি গড়ে তুলেছি, মানবিক ও স্বশিক্ষিত মূল্যবোধের চর্চায় পিছিয়ে রয়েছি। এই মানবিকতার অবক্ষয়ের দুর্গতির দায় তো আমাদেরই। কোমলমতি শিশুদের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পাঠ্যপুস্তকের অপ্রাসঙ্গিক বয়স অনুপোযোগী শিক্ষার চেয়ে মূল্যবোধ শিক্ষায় জোর দেওয়া হোক। এতে জাতির সততার ভিত গড়ে উঠবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটি চিঠি
পরবর্তী নিবন্ধমূল্যবোধের সর্বগ্রাসী সংকট