আমরা মুসলমান। আমরা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের প্রতি ঈমান এনেছি। মুসলমান হওয়ার জন্য প্রথম শর্তই হলো ঈমান। আল্লাহ এক তাঁর কোনোই অংশীদার নেই। আর হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। তাওহিদ মানে আল্লাহর একত্ববাদ। এর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও মুখে স্বীকার করা এবং আল্লাহকেই একমাত্র মাবুদ হিসেবে মেনে নেওয়া প্রত্যেকের জন্য ফরজ। ফজিলত ও মর্যাদাপূর্ণ সুরা ইখলাস। সুরা ইখলাস পবিত্র কোরআনের ১১২তম সুরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে।
সুরা ইখলাসের অর্থ : পরম করুণাময় পরম দয়াময় আল্লাহর নামে ১. বলো তিনি আল্লাহ (যিনি) অদ্বিতীয় ২. আল্লাহ সবার নির্ভরস্থল ৩. তিনি কাউকে জন্ম দেননি ও তাঁকেও কেউ জন্ম দেয়নি ৪. আর তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। কোরআন শরিফ আমাদের তিনটি মৌলিক জিনিস শেখায় : তওহিদ, আখিরাত ও রিসালাত। অর্থাৎ আল্লাহ, পরকাল ও অহি। অন্য যেকোনো বিশ্বাস এই তিনটার মধ্যে পড়ে যায়। আল্লাহ, আখিরাত এবং আল্লাহর প্রেরিত ওহির প্রতি বিশ্বাস। যখন আমরা বলি আল্লাহকে বিশ্বাস করি এর মধ্যে আল্লাহর সব নাম, সব গুণ, কাজকে বোঝায়। যখন বলি আখিরাতে বিশ্বাস তার মধ্যে কবরের জীবন, বিচার দিবস, জান্নাত, জাহান্নাম–সব এসে যায়।
কোরআনের এক–তৃতীয়াংশ : হাদিসে এসেছে একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন তোমরা সবাই একত্র হয়ে যাও আমি তোমাদের কোরআনের এক–তৃতীয়াংশ শোনাব। এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) সুরা ইখলাস পাঠ করলেন। সহিহ হাদিসে আছে সুরা ইখলাস তিনবার পাঠ করলে এক খতম কোরআন তিলাওয়াতের সমপরিমাণ সওয়াব পাওয়া যায়। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে এক রেওয়ায়েতে উল্লেখ আছে এক যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে আমির বা নেতা নিযুক্ত করে দেন তিনি নামাজে ইমামতি কালে সুরা ফাতিহা ও অন্য সুরা শেষে প্রতি রাকাতেই সুরা ইখলাস পাঠ করতেন।
তিলাওয়াতকারীর গোনাহ মাফ : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যে ব্যক্তি প্রতিদিন ২০০ বার সুরা ইখলাস পড়বে তার ৫০ বছরের গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে তবে ঋণ থাকলে তা মাফ হবে না। সূরা ইখলাস তিলাওয়াতকারীর গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয় : আবুল হাসান মুহাজির (রাহ.) বলেন জনৈক সাহাবি বর্ণনা করেছেন তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাথে এক সফরে ছিলেন (একদিন তাঁর কাছে এমনভাবে বসা ছিলেন যে) তার দুই হাঁটু নবীজীর হাঁটুদ্বয়ের সাথে লেগে ছিল। এ অবস্থায় এক লোককে শুনলেন সূরা কাফিরুন তিলাওয়াত করছে। তা শুনে নবী (সা.) বললেন সে শিরক থেকে পবিত্র হয়ে গেছে। আরেক লোককে শুনলেন সূরা ইখলাছ তিলাওয়াত করছে। তখন তিনি বললেন তাকে মাফ করে দেয়া হয়েছে।
সুরা ইখলাসের আমল : রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘুমানোর আগে কুলহুআল্লাহু আহাদ, কুল আউযু বিরাব্বিল ফালাক, কুল আউযু বিরাব্বিন নাস পড়ার কথা বলেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন বিছানায় ঘুমানোর জন্য যেতেন তখন তিনি তাঁর দুই হাতের তালু একত্র করতেন তারপর সেখানে সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক ও সুরা নাস পড়ে ফুঁ দিতেন। এরপর দুই হাতের তালু দিয়ে শরীরে যতটুকু সম্ভব হাত বুলিয়ে দিতেন। এভাবে তিনবার করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন অসুস্থ হন তখন তিনি আমাকে অনুরূপ করার নির্দেশ দিতেন। (সহিহ্ বোখারি : ৫২২৪)
দারিদ্র্যতা দূর : হজরত সাহল ইবন সাদ সায়েদি (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে দারিদ্র্যের অভিযোগ করল নবী কারিম (সা.) তাকে বললেন যখন তুমি ঘরে যাও তখন সালাম দেবে এবং একবার সুরা ইখলাস পড়বে। এ আমল করার ফলে কিছুদিনের মধ্যে তার দারিদ্র্য দূর হয়ে যায়। ১. যে ব্যাক্তি একবার সূরা ইখলাস পাঠ করলো : সে কুরআন কারীমের এক তৃতীয়াংশ পাঠ করার সওয়াব লাভ করলো। ২. যে ব্যাক্তি সূরা ইখলাস দশবার পাঠ করলো : আল্লাহুতায়ালা নিজ কুদরতি হাতে জান্নাতের মধ্যে তার বিশেষ মর্যাদাশীল মহল তৈরী করবে। ৩. যে ব্যাক্তি অধিক পাঠ করবে : আল্লাহুতায়ালা তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব করে দিবেন। ৪. যে ব্যাক্তি অধিক পরিমাণে পাঠ করবে : আল্লাহুতায়ালা তার জন্য লাশ বহন করার জন্য হযরত জিবরাঈল (আ.) এর সাথে ৭০ হাজার ফেরেশতা প্রেরণ করবেন। ফেরেশতারারা তার লাশ বহন ও জানাজাই শরিক হবেন।
আল্লাহতাআলার গুণাবলি বিবেচনায় তাঁর বহু নাম রয়েছে যা ‘ইসমে সিফাত’ বা গুণবাচক নাম। এগুলোকে ‘আসমাউল হুসনা’ বলা হয়। কোরআন মাজিদে রয়েছে : আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার রয়েছে সুন্দর সুন্দর নামসমূহ। তোমরা তাঁকে সেসব নামে ডাকো। (সুরা–৭ : আরাফ, আয়াত : ১৮০)। তোমরা আল্লাহ নামে ডাকো অথবা রহমান নামে তাঁকে ডাকো (যে নামেই ডাকো তিনি সাড়া দেবেন)। তাঁর রয়েছে সুন্দরতম নামসমূহ। (সুরা–১৭ : ইসরা, আয়াত : ১১০)। আল্লাহকে বিশ্বাস করা মানেই হলো তাঁর জাত ও সিফাত (সত্তা ও গুণাবলি) বিশ্বাস করা। ঈমানে মুজমালে উপরিউক্ত বিষয়টি পূর্ণাঙ্গরূপে প্রকাশ করা হয়েছে। যথা : আমি ইমান আনলাম তথা বিশ্বাস করলাম আল্লাহর প্রতি যেমন যেরূপ আছেন তিনি তাঁর নামাবলি ও গুণাবলিসহ এবং আমি মেনে নিলাম তাঁর সকল আদেশাবলি ও নিষেধাবলি। মহাজগতে প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অস্তিত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ সমুজ্জ্বলরূপে বিদ্যমান। আল্লাহতাআলার অস্তিত্বের অসংখ্য নিদর্শন মানব সৃষ্টি এবং সৃষ্টিকুলের অপরাপর সৃষ্টিসমূহের মধ্যে বিরাজমান। প্রবাদ রয়েছে স্থাপত্য দেখে স্থপতি চেনা যায় : লেখা দেখে লেখক চেনা যায় : কবিতা দেখে কবির পরিচয় পাওয়া যায়। তাহলে কি এ বিশাল সৃষ্টি ও তাতে বিদ্যমান নিদর্শনাবলি দেখে এ সবের অস্তিত্ব দানকারী আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া কি যায় না। পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট ঘোষণা আর তোমাদের উপাস্য একমাত্র আল্লাহতায়ালাই। তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই ; তিনিই পরম দয়াময় ; অনন্ত অসীম করুণাময়। (সুরা বাকারা,আয়াত : ১৬৩)। অতএব ইবাদত করতে হবে শুধু এক আল্লাহর। তবেই পরকালে চিরস্থায়ী জীবনের নাজাত লাভ সম্ভব।
আল্লাহই তার বান্দার জন্য যথেষ্ট : সুরা ইখলাসের দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহতায়ালা ‘সমাদ’ অমুখাপেক্ষী। ‘সমাদ’ বলা হয় এমন এক সত্তাকে যিনি সর্ব গুণাবলিতে পরিপূর্ণ। সব সৃষ্টি যার দিকে মুখাপেক্ষী। তিনি সবার থেকে অমুখাপেক্ষী। তার মৃত্যু নেই। তিনি কারও উত্তরাধিকারী নন। বরং আকাশ–জমিনের সব উত্তরাধিকার তার। তিনি না ঘুমান না উদাসীন হন। তার নেতৃত্ব সর্বময়। জ্ঞানে প্রজ্ঞায় ধৈর্যে ক্ষমতায় সম্মানে। এক কথায় সব গুণাবলিতে তিনি মহান। তিনি এমন সত্তা প্রয়োজনের সময় সব মাখলুক যার দিকে মুখাপেক্ষী হয়। আর তিনি একাই সবার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। ‘সমাদ’ নাম বান্দার মধ্যে তার ক্ষমতা সম্মান এবং সবকিছু থেকে তার অমুখাপেক্ষীতার অনুভূতি তৈরি করে। ফলে বান্দার বিশ্বাস স্থির হয়ে যায় আল্লাহই তার বান্দার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহর ভালোবাসা ও নেয়ামতে ভরপুর জান্নাতের প্রসাদ পেতে নিয়মিত সুরা ইখলাসের আমল করা জরুরি। এতে যেমন ঈমান হবে পরিপূর্ণ তেমনি পরকালের পুরস্কার হবে সুনিশ্চিত। আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহকে তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদের ওপর অটল ও অবিচল থেকে তার পরিচয় ও গুণাবলি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ও সুরা ইখলাসের আমল বেশি বেশি করার তাওফিক দান করুন। আমিন। ইয়া রাব্বুল আলামিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট