চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) নবাগত কমিশনার হাসিব আজিজ বলেছেন, দেশে একটি সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পুলিশ বাহিনীকে জনগণের সত্যিকারের সেবক, জনবান্ধব এবং জনগণের বন্ধু হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আমরা আমাদের কাজের মাধ্যমে, আন্তরিকতার মাধ্যমে এবং সেবার মাধ্যমে সিএমপিকে বাংলাদেশ পুলিশের জন্য একটি রোল মডেলে পরিণত করতে চাই। আমি আমার সহকর্মীদের ইতোমধ্যে সে কথা বলেছি। আমরা সবাই মিলে সবার সহযোগিতায় সিএমপিকে অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে পুলিশি সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে চাই।
আগামী রোববার থেকে প্রতি রোববার সিএমপির উপ–পুলিশ কমিশনারদের কার্যালয় এবং প্রতি মঙ্গলবার সিএমপি কমিশনারের কার্যালয় চট্টগ্রামের সকল শ্রেণি–পেশার মানুষ তথা জনগণের জন্য উন্মুক্ত রাখার ঘোষণা দিয়ে সিএমপি কমিশনার বলেন, নগরীর যে কেউ খালি পায়ে কিংবা লুঙ্গি পরে এসেও ওপেন হাউজ ডে’তে নিজেদের কথা বলতে পারবেন। যারা পুলিশি সেবা পাননি বা নির্যাতিত হয়ে বিচার পাননি বা অভিযোগ করতে পারেননি তারা পুলিশি সেবার ব্যাপারে তাদের বক্তব্য উপ–পুলিশ কমিশনার বা আমার কাছে তুলে ধরতে পারবেন। আমরা প্রতিটি অভিযোগকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করব।
সিএমপি কমিশনার গতকাল রোববার বিকালে দৈনিক আজাদীর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আমরা সমাজ থেকে অপরাধ দূর করতে চাই। আরো বড় করে বলতে চাই, আমরা সমাজ থেকে অপরাধজনিত ভীতি দূর করতে চাই। এজন্য সমাজের শান্তিপ্রিয় মানুষ যারা আছেন তাদের সাথে পুলিশের মেলবন্ধনের কোনো বিকল্প নেই। আমরা পুলিশের সাথে জনগণের কোনো দূরত্ব রাখতে চাই না। একসাথে অপরাধ এবং অপরাধীদের দমনে কাজ করতে চাই।
তিনি বলেন, আমাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। এগুলো মোকাবেলা করে পুলিশের সাথে জনগণের দূরত্ব কমিয়ে পুলিশকে জনগণের বন্ধু বানাতে চাই। আমরা আক্ষরিক অর্থেই জনগণের সেবক এবং বন্ধু হতে চাই।
তিনি বলেন, ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত গত ১৫ বছরে পুলিশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। পুলিশকে এই জনবিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠতে হবে। পুলিশের সাথে সাধারণ জনগণের নৈকট্য বাড়াতে হবে। পুলিশকে এত বেশি পক্ষপাতদুষ্ট করে ফেলার চেষ্টা হয়েছে যে, এতে পুলিশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই জনবিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে ওঠার জন্যই আমরা সাধারণ নাগরিক সমাজের সাথে পুলিশি কার্যক্রমের সমন্বয় ঘটিয়ে পুলিশকে জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি। আমরা সমাজের শান্তিপ্রিয়, সমাজসেবক এবং সমাজ সংস্কারক মানুষদের নিয়ে সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল করতে চাই।
এক প্রশ্নের জবাবে সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, সিএমপিকে অনেকগুলো বিষয়ে কাজ করতে হয়। মূল কাজ হচ্ছে ক্রাইম ওয়ার্ক। ৫ তারিখের পরে সিএমপির থানা এবং ফাঁড়ির প্রচুর অস্ত্র লুট হয়েছে। এসব অস্ত্রের অনেকগুলো এখনো উদ্ধার হয়নি। এগুলো উদ্ধার করাই এখন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। পুলিশের অস্ত্র অবৈধভাবে কোনো সন্ত্রাসীর হাতে থাকবে, তা মেনে নেওয়া যায় না। তাই এসব অস্ত্র যেকোনো মূল্যেই উদ্ধার করা হবে। এছাড়া সন্ত্রাসীদের হাতেও নিশ্চয় অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। সেগুলোও আমাদেরকে উদ্ধার করতে হবে। অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি সন্ত্রাসীদেরও গ্রেপ্তার করতে হবে। এখন আমরা এই দুটি বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি।
নগরীর কয়েকটি পয়েন্টে দিনের বেলা যানজটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি নতুন এসেছি। তবে এই শহর আমার কাছে একেবারে অপরিচিত নয়। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশে তিন বছর কাজ করার সুবাদে শহরের অনেক কিছুই আমি চিনি। শহরের কয়েকটি পয়েন্টে দিনের বেলায় প্রচুর যানজট হয়। এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণ করা হচ্ছে, ওয়াসার কিছু কাজ চলছে। এতে করে রাস্তা সরু হয়ে গেছে। এছাড়া অবৈধ পার্কিং, যেখানে সেখানে গাড়ি দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল, ব্যাটারি রিকশা বা অটোসহ বিভিন্ন ধরনের অবৈধ যানবাহন চলাচল ট্রাফিক ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা কঠিন করে তুলেছে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে আমরা নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে কাজ শুরু করেছি। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়ে যানজটকে একটি সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছি।
সিএমপির কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম প্রসঙ্গে নবাগত কমিশনার বলেন, কমিউনিটি পুলিশের আগের সবগুলো কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জোনের ডিসি এবং ওসিদেরকে আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে নতুন কমিটির নাম প্রস্তাব পাঠানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছি। আমি বলে দিয়েছি, রাজনৈতিক হোক বা অরাজনৈতিক হোক ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষদের নিয়ে কমিউনিটি পুলিশের থানা কমিটি করতে হবে। তাদেরকে কমিটির নাম দিয়ে প্রস্তাব পাঠানোর জন্য বলেছি। আমরা যাছাই বাছাই করে থানা কমিটিগুলো হয়ে গেলে পরবর্তীতে সিএমপির মূল কমিটি পুনর্গঠন করা হবে। কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে আমরা পুলিশকে জনগণের একেবারে কাছাকাছি নিয়ে যেতে চাই। এক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের সাথে পরামর্শক্রমে কমিটিগুলো গঠন করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে হাসিব আজিজ বলেন, ৫ তারিখের পরে পুলিশ ফোর্সের ভিতরে এক ধরনের হতাশা চলে এসেছে। সেটা কাটিয়ে ওঠার জন্য ফোর্সের সাথে কর্মকর্তাদের যোগাযোগ বাড়িয়ে তাদের মনোবল চাঙ্গা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। গেল শুক্রবার আমি অনেকের সাথে কথা বলেছি। থানা এবং ফাঁড়িসহ বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত ফোর্সদের সাথে কর্মকর্তাদের যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য আমাদের আরো বেশ কিছু কর্মসূচি রয়েছে। কালও আমাদের কিছু কার্যক্রম রয়েছে।
শহরে মোবাইল টিম বাড়ানো সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা শহরে মোবাইল টিম বাড়ানোর জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছি। পুলিশের গাড়ি সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সিএমপির থানা এবং ফাঁড়ির বহু গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে যেগুলো মেরামতযোগ্য সেগুলো মেরামত করানোর ব্যবস্থা করেছি। কাজ চলছে। আর যেগুলো মেরামতযোগ্য নয় সেগুলো পুলিশ সদর দফতর থেকে চাওয়া হয়েছে। ৭০টি মোটরসাইকেল এবং ৩৬টি গাড়ি মেরামতযোগ্য নেই। এগুলো পুলিশ সদর দফতর থেকে এনে থানা ও ফাঁড়িগুলোতে দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ভাড়া গাড়ি নিয়ে বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়িতে টহলের জন্য দেওয়া হয়েছে। সিএমপির পুলিশ ফোর্স পুরোপুরি কাজে যোগ দিয়েছে বলেও জানান তিনি।
চট্টগ্রামের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুরো দেশের জন্য রোল মডেল মন্তব্য করে পুলিশ কমিশনার বলেন, চট্টগ্রামের মানুষ অসাম্প্রদায়িক। চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্য আছে। সম্প্রীতির বহু নজির আছে। চট্টগ্রামের মানুষ সত্যিকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী। চট্টগ্রামের মানুষের মাঝে এই যে সম্প্রীতি, এটাকে আরো বহু গুণে বৃদ্ধি করতে চাই। তিনি বলেন, এই শহরে সাম্প্রদায়িক শান্তি যাতে বিরাজ করে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য সিএমপির পক্ষ থেকে যা যা করা দরকার তার সবটুকই করব। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, সকল ধর্মের মানুষ রাষ্ট্রের সমান নাগরিক। প্রত্যেক সম্প্রদায় যাতে নিরাপদে, নির্বিঘ্নে তাদের ধর্ম পালন করতে পারে, তাদের উৎসব করতে পারে, প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মধ্যে যাতে পরস্পরের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা, বন্ধুত্ব এবং সদ্ভাব বজায় থাকে পুলিশ সেটা অবশ্যই নিশ্চিত করবে।