সুফিয়া কামাল (১৯১১–১৯৯৯)। প্রথিতযশা কবি ও নারী প্রগতি আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার বাড়ি কুমিল্লায়। তাঁর বাবা সৈয়দ আবদুল বারি পেশায় ছিলেন উকিল। সুফিয়া কামাল তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তখনকার পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবেশে বাস করেও তিনি নিজ চেষ্টায় হয়ে ওঠেন স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত। বাড়িতে উর্দুভাষার চল থাকলেও নিজ উদ্যোগেই তিনি বাংলা ভাষা রপ্ত করেন। যে সময়ে মুসলিম মেয়েরা শিক্ষা–দীক্ষায় ছিল একেবারেই পশ্চাৎপদ, সে সময়ে সুফিয়া কামালের মতো স্বশিক্ষিত ও সমাজপ্রগতি–সচেতন নারীর আবির্ভাব ছিল এক অসাধারণ ব্যাপার। স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনের অনুপ্রেরণায় তিনি সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠেন। ১৯২৩ সালে বরিশালের তরুণ পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প ‘সৈনিক বধূ’ প্রকাশের মাধ্যমে তাঁর লেখক সত্তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯২৫ সালে বরিশালে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সুফিয়ার সাক্ষাৎ হয়। গান্ধীর স্বাধীনতা সংগ্রামের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি নারীকল্যাণমূলক সংগঠন ‘মাতৃমঙ্গল’–এ যোগ দেন। ১৯২৬ সালে তার প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ সেসময়ের প্রভাবশালী সাময়িকী সওগাতে প্রকাশিত হয়। ১৯৩২ সালে তাঁর স্বামী মারা যান। ১৯৩৯ সালে আপনজন ও শুভানুধ্যায়ীদের ইচ্ছায় তিনি চট্টগ্রামের লেখক ও অনুবাদক কামালউদ্দীন আহমদের সঙ্গে পুনরায় পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। সেই থেকে তিনি ‘সুফিয়া কামাল’ নামে পরিচিত হন। ১৯৪৭ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা প্রকাশ করলে তিনি তার প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সুফিয়া কামাল সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার আগে ও পরে তিনি বহু সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’ (১৯৩৮), ‘মায়া কাজল’ (১৯৫১), ‘মন ও জীবন’ (১৯৫৭), ‘প্রশস্তি ও প্রার্থনা’ (১৯৫৮), ‘উদাত্ত পৃথিবী’ (১৯৬৪), ‘দিওয়ান’ (১৯৬৬), ‘অভিযাত্রিক’ (১৯৬৯), ‘মৃত্তিকার ঘ্রাণ’ (১৯৭০), ‘মোর জাদুদের সমাধি পরে’ (১৯৭২), ‘কেয়ার কাঁটা’ (১৯৩৭), ‘সোভিয়েতে দিনগুলি’ (১৯৬৮), ‘একাত্তরের ডায়েরি’ (১৯৮৯), ‘একালে আমাদের কাল’ (১৯৮৮), ‘ইতল বিতল’ (১৯৬৫), ‘নওল কিশোরের দরবারে’ (১৯৮১)। তাঁর কবিতা চীনা, ইংরেজি, জার্মান, ইতালিয়ান, পোলিশ, রুশ, ভিয়েতনামিজ, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২), একুশে পদক (১৯৭৬), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৭) লাভ করেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের Lenin Centenary Jubilee Medal (1970) এবং Czechoslovakia Medal (1986) সহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও লাভ করেন। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।