জাহাঁগিরিয়া তরিকার প্রধান পথপ্রদর্শক শেখুল আরেফিন হযরত মৌলানা শাহ্সুফি মুখলেছুর রহমান জাহাঁগিরি (রহ.)। তাঁর পরে এই তরিকাকে প্রসারে ভূমিকা রাখেন ফখরুল আরেফিন হযরত শাহ্সুফি শেখ আবদুল হাই জাহাঁগিরি (রহ.), হযরত শাহ্সুফি সৈয়্যদ মাওলানা আমজাদ আলী জাহাঁগিরি (রহ.), হযরত শাহ্সুফি মুফতি সৈয়্যদ মাওলানা মমতাজ আলী জাহাঁগিরি (রহ.), হযরত শাহ্সুফি মাওলানা মোহাম্মদ আলী জাহাঁগিরি মমতাজি (মু.জি.আ)সহ দেশবিদেশের অনেক জ্ঞানী ও গুণী তরিকতের খেলাফতপ্রাপ্ত বিজ্ঞ আলেম ও অলিগণ।
সুফিবাদ জীবনের পবিত্র শুদ্ধ ইসলামের ধর্মচর্চায় শাহ্সুফি মুফতি সৈয়্যদ মমতাজ আলী জাহাঁগিরিয়া (রহ.) এর অবদান অপরিসীম। পবিত্র ইসলামকে সঠিক পরিশুদ্ধ ও নিষ্ঠার সাথে পালনের অন্যতম মূলমন্ত্রই হচ্ছে সুফিবাদ। সুফিবাদ আরবী তাসাউফ থেকে এসেছে। তাসাউফের মূল বিষয় হলো– তাসফিয়াহ্ বা পরিচ্ছন্নতা। তাসাউফের সংজ্ঞা প্রায় দুই হাজারের উপরে রয়েছে। এখানে সুফি ইবনে উজাইবার (রহ.) মতকে শ্রেয় মনে করেছি– অন্তর শক্তিকে অন্যায়–অপরাধ মুক্ত করে বিভিন্ন প্রকার গুণাবলী দ্বারা সজ্জিত করত: আল্লাহর পথে চলার পন্থা যে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে জানা যায়, সে জ্ঞানকে ‘তাসাউফ’ বা ‘সুফীবাদ’ বলে। আমরা সুফিবাদের আদর্শের আয়নায় চট্টগ্রামের বিখ্যাত সুফীসাধক হযরত শাহসুফি মমতাজ আলী জাহাঁগিরি (রহ.) এর জীবন চরিত দেখতে পায় মানুষ ও মানবতার কল্যাণে নিবেদিত। হযরত শাহসুফি মাওলানা মুহাম্মদ মমতাজ আলী জাহাঁগিরি (রহ.) ছিলেন মহান আদর্শের এক উজ্জ্বল নমুনা। তিনি আল্লাহ ও প্রিয় রাসূল (সা.) এর দেখানো পথেই মানুষকে শান্তির জন্য আহ্বান করেছেন সারাজীবন। কোরআন ও হাদিসের আলোকে মানুষকে আহ্ববান করে ইহকাল ও পরকালের মুক্তির নির্দেশনা দিয়েছেন। তাঁর মতো আদর্শবান সুফিতাত্ত্বিক ও সুফিবাদ জ্ঞান সম্পন্ন বুজুর্গ বর্তমান সময়ে বিরল। সিলসিলা–ই–জাহাঁগিরিয়ার প্রখ্যাত বুজুর্গ, বাংলাদেশে সূফিদের স্বর্ণযুগের অন্যতম সূফিসাধক, ইমামে আশেকে রাসুল, গৌছেআলম বা খেতাবে ইমামুল আরেফিন, হযরতুলহাজ মুফতী মৌলানা শাহসূফী মমতাজ আলী কাদেরী চিশ্তি আবুল উলায়ী জাহাঁগিরি (ক.সি.আ.) ১৯১৩ ইংরেজি সালে, মোতাবেক হিজরী ১৩৩১ সালে পৈত্রিক নিবাস ঐতিহ্যবাহী দক্ষিণ চট্টগ্রামের তৎকালীন পটিয়া উপজেলার (বর্তমান চন্দনাইশ) শাহসুফি হযরত আমজাদ আলী নুরুল হুদা জাহাঁগিরি (রহ.) এর গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন জগৎ বিখ্যাত সুফি, কুতুবে আলম হযরত শাহসূফী আমজাদ আলী জাহাঁগিরি (রা.) এবং মাতা বেগম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। তাঁর পিতা হযরত শাহসূফী আমজাদ আলী জাহাঁগিরি (রহ.) ছিলেন স্বীয় প্রজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ও প্রখ্যাত কামেল বুজুর্গ। হযরত ফখরুল আরেফিন (রহ.) এর ওফাতকালীন আদেশানুযায়ী তিনি মুর্শিদ কেবলা হযরত ফখরুল আরেফিন (রহ.) ওফাতের পর দীর্ঘ ১৮ বছর দরবারে জাহাঁগিরি পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৩৯ সালে তার ওফাতের পূর্ব পর্যন্ত তিনি দরবারে জাহাঁগিরিয়া পরিচালনা করেছিলেন। হযরত শাহসূফী মমতাজ আলী (রা.) ছিলেন তার পিতা মাতার দ্বিতীয় সন্তান। দ্বিতীয় পুত্রের জন্মগ্রহনের সুসংবাদ নিয়ে তার পিতা স্বীয় মুর্শিদ কেবলার কাছে গমন করিলে, তাঁর পিতার মুর্শিদ হযরত ফখরুল আরেফিন (রহ.) আনন্দিত হয়ে সদ্যজাত এই সন্তানের নামকরণ করেন ‘মমতাজ আলী’। তিনি তাঁকে অন্য কোন ডাকনামে না ডাকতে নিষেধ করে দেন। আরবী ভাষায় মমতাজ শব্দটির অর্থ মনোনীত বা নির্বাচিত। হযরত মমতাজ আলী (রহ.) প্রথমে কাঞ্চননগর শাহসুফি দরবার শরীফে নিজ গৃহে পিতার কাছে শিক্ষা শুরু করেন। বাড়ির প্রাথমিক শিক্ষা শেষে চট্টগ্রাম শহরের দারুল হাদিস নামক একটি মাদ্রাসায় সুফি আহসান উল্লাহ নামক নামজাদা শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে পড়া–লেখা করেন। পরে সীতাকুন্ড আলীয়া মাদ্রাসা কয়েক বছর, অতপর সন্দ্বীপ জাহাঁগিরিয়া মাদ্রাসায় হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ শাহ (রহ.) এর সংস্পর্শে লেখা–পড়া করেন। ঐ মাদ্রাসা থেকে আনুষ্ঠানিক সনদ লাভ করার পর যে সকল বিষয়ে বুৎপতিত্ত অর্জন করে তিনি সনদ লাভ করেন তা হলো– কুরআন শরীফ, হাদিস শরীফ, তফসীর, ফিকাহ ও উসুলে ফিকাহ, ইলমে কালাম, ইলমে বালাগাত ও মানতিক। এরপর হযরত মমতাজ আলী অতিরিক্ত বরকত লাভের উদ্দেশ্যে তৎকালীন সময়ে ভারতের প্রসিদ্ধ আলেম ও সুফি সাধক হযরত আল্লামা নঈম উদ্দিন মুর্দাবাদীর সান্নিধ্য লাভ করেন। তিনি মুর্দাবাদী (রাহ.)-এর হাতে সিহাহ সিত্তার হাদিসগুলো যথাক্রমে– বোখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, ইবনে মাজাহ শরীফ, নাসায়ী শরীফ, আবু দাউদ শরীফ এবং তিরমিজী শরীফের ওপর বুৎপত্তি অর্জনের সনদ লাভ করেন। এরপর বাংলাদেশে চলে আসেন। “বাড়ীতে অবস্থানকালে একরাত্রে তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে হযরত আল্লামা আজিজুল হক শেরে বাংলা (রহ.) এর নিকটে তাফসীরে জালালাইন শরীফের পাঠ গ্রহণ করেন।”– প্রবন্ধ সম্ভার, শাহজাহা মুহাম্মদ মাহফুজ আলী।
হযরত শাহসুফি মাওলানা মুহাম্মদ মমতাজ আলী (রহ.) ছাত্র জীবন থেকেই একটানা পাঁচ বছর সুফিবাদের জ্ঞান অর্জনের লক্ষে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মহান সাধকদের মাজার শরীফ জিয়ারত করে সুফিবাদের জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি জগতবিখ্যাত হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) মাজার শরীফ, কুতুব উদ্দিন বখতেয়ার কাকী (রহ.), শেখ ফরিদ গঞ্জে শখর (রহ.) পাক পাঠন, পাকিস্তান, হযরত আলী হাজবেরী দাতা গঞ্জে বখশ লাহোরী, লাহোর, পাকিস্তান, হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া (রহ.) দিল্লী, ভারত, হযরত মীর আবুল উলা (রহ.) আগ্রা, ভারত, হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দী (রহ.), হযরত হামিদুদ্দীন নাগোরী (রহ.), হযরত এমদাদ আলী (রহ.), ভাগলপুর, ভারত, হযরত আব্দুল কুদ্দুস গনগোহী (রহ.), হযরত নবী রেজা খাঁন, লক্ষ্ণৌ, ভারত, হযরত আশরাফ জাহাঁগিরি চেমনানী (রহ.) কাছওয়াছা, ভারত, হযরত আব্দুস শুক্কুর শাহ (রহ.), বেনারস, ভারত প্রমুখ। হযরত শাহসুফি মমতাজ আলী (রহ.) এরপর চট্টগ্রাম কাঞ্চননগর শাহসুফি দরবার শরীফে চলে আসেন। তাঁর পিতার আদেশ ও মুর্শিদ কেবলারূপে তাঁকে মেনে জীবন অতিবাহিত করেন। তাঁর পিতা হযরত আমজাদ আলী (রহ.) তাঁকে খেলাফত প্রদান করেন। এরপর থেকে তিনি জাহাঁগিরিয়া শাহসুফি দরবার শরীফের শান মান রক্ষা করে পবিত্র মুর্শিদের বাণী এবং কোরআন হাদিসের শিক্ষাই হাজার হাজার মুরিদকে ইহকাল ও পরকালের শিক্ষা দিয়ে আলোকিত জীবনের অধিকারী করে তোলেন সমগ্র বাংলাদেশে শাহসুফি দরবার শরীফে চারশতাধিক খানাকা শরীফ রয়েছে। হযরত শাহসুফি মাওলানা মমতাজ আলী জাহাঁগিরি (রহ.) এর লিখিত একটি ঐতিহাসিক কিতাব রয়েছে। কিতাবটির নাম “মমতাজুল ফতওয়া”।
এই কিতাবটিতে তিনি ছেমা মাহফিল ও সিজদায়ে তাহিয়ার বৈধতা ও উপমহাদেশের ওহাবী আকিদা প্রচারকারী আলেমদের বিরুদ্ধে মক্কা ও মদিনা শরীফের ১০ জন আলেমের ফতওয়া প্রদান ও ১১১টি ঐতিহাসিক কিতাবের তথ্য সংযোজনে রচনা করেছেন। মমতাজুল ফতওয়া সম্পর্কে ইমামে আহলে সুন্নত আল্লামা হযরত নুরুল ইসলাম হাশেমী (রহ.) কিতাবটি পড়ে অসাধারণ গুণবাচক মন্তব্যের মাধ্যমে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। মহান এই সাধক পুরুষ ২০১০ সালে মোতাবেক ১৪৩১ হিজরীর ১০ সফর মহান আল্লাহর দিদার লাভ করেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সভাপতি–সিএইচআরসি, বাংলাদেশ।