আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিশু অধিকার সুরক্ষা, শিশুর উন্নয়ন, বিকাশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ০৭ অক্টোবর বিশ্ব শিশু দিবস পালিত হচ্ছে। এবারে এই দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘প্রতিটি শিশুর অধিকার রক্ষা আমাদের অঙ্গীকার।’ শুরুতে বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ উপলক্ষে সকল শিশু, অভিভাবকদের স্বাগত জানাচ্ছি, সেই সাথে সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন ঘিরে দেশব্যাপী সহিংসতার ফলে নিহত শিশুদের স্মরণ করছি। গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি আহত শিশু ও তাদের পরিবারের প্রতি।
শিশুর উন্নতি ও সমৃদ্ধির উপর দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি নির্ভর করে। শিশুকাল হলো মানুষ গড়ার উপযুক্ত সময়। শিশুর কোমলমতি মন যে শিক্ষা লাভ করে, পরিণত বয়সে তাদের কাজকর্মে তারই প্রতিফলন দেখা যায়। একটি সুন্দর শিশুর ভবিষ্যতের জন্য শিশুর শারীরিক মানসিক সুস্থতার পাশাপাশি তাদের চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতা, সর্বোপরি তাদের সমস্ত সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণভাবে বিকাশ করার জন্য গোটা বিশ্ব মনোযোগ দিচ্ছে। ১৯২৪ সালে সর্বপ্রথম লীগ অব নেশনস ঘোষণা করেছিল, মানবজাতির সর্বোত্তম যা কিছু দেওয়ার আছে শিশুরাই তা পাওয়ার যোগ্য। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৩ সালে বিশ্বের ৪০ টি দেশে প্রথম উদযাপিত হয় বিশ্ব শিশু দিবস।
পরবর্তীতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৫৪ সালে অক্টোবর মাসের ১ম সোমবার বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৫৯ সালের ২০ নভেম্বর ১০ টি মৌলিক অধিকার নিয়ে শিশু অধিকার সনদ ঘোষণা করা হয়। সর্বশেষ ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৫৪ ধারা বিশিষ্ট শিশু অধিকার সনদ প্রণীত হয়। বিশ্বের ১ম যে ২২টি দেশ শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। ৫৪ টি ধারার শিশু অধিকার সনদে রাষ্ট্রের দায়িত্বসহ পিতামাতা, অভিভাবকদের করণীয় পালনের বিষয়ে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা রয়েছে।
শিশু অধিকার সনদের মূল কথা হচ্ছে, ধনী– গরিব নির্বিশেষে শিশুদের ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য করা যাবে না। শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিশুর খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, আইনগত নাগরিক ও সামাজিক সেবা প্রদান এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে শিশু অধিকার সংরক্ষণ করা হয়। শিশুর অংশগ্রহণ, মত প্রকাশ করা ও শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
শিশুদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে দারিদ্রতা ও অভিভাবকদের অসচেতনতা। দরিদ্র শিশুরা সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শিশুদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সকল শিশু বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। পথশিশুদের পুনর্বাসন, বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ, শিশুর অপুষ্টি দূরীকরণ, চিকিৎসা অধিকার, শিশু নির্যাতন ও শিশু পাচার প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ, কন্যা শিশুদের বৈষম্য বিলোপ সাধন, বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ, প্রতিবন্ধী, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের কার্যক্রম ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কার্যক্রমকে জোরদার করতে হবে।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। শিশু অধিকার বাস্তবায়নে প্রয়োজন ব্যাপক গণসচেতনতা। মা–বাবা, অভিভাবক, শিক্ষকদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে সমাজ সচেতন সুশীল মানুষদের। দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আদর–যত্ন, ভালোবাসা দিয়ে শিশুদের বড় করে তুলতে হবে। শিশুদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, জাতি গঠনের মূল ভিত্তি হচ্ছে শিশু। শিশুরা প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের সম্পদ, রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। সম্প্রতি ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে তরুণ ছাত্রসমাজ, গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
নতুন দেশ নির্মাণে তরুণ ছাত্রসমাজের পাশাপাশি স্কুল পড়ুয়া কিশোর–কিশোরীরাও উৎসর্গ করেছে তাদের জীবন। নতুন বাংলাদেশকে গড়তে হলে জেনারেশনকে দক্ষ মানবসম্পদরূপে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা– শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ, সুন্দর শৈশব ও অধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগ দিবেন। এ দিবস পালন তখনই সার্থক হবে যখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু সুস্থ ও সুন্দর ও সুনাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পাশাপাশি এনজিও সংগঠন, শিশুসংগঠন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিশুদের প্রত্যাশিত স্বপ্নের জগত তৈরী করা সম্ভব হবে। আসুন, সকলে মিলে জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ হই, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি । কবির ভাষায় বলা যায়–
‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ মৃত আর ধ্বংসস্তুপ–পিঠে নিয়ে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব– তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে সরাব পৃথিবীর জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব–
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’।
লেখক : সাবেক শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা, জেলা শিশু একাডেমি, চট্টগ্রাম।