কামরুল হাসান বাদলের কলাম যাঁরা নিয়মিত পড়েন, তাঁরা জানেন তিনি একজন সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষক এবং সমাজসচেতন মানুষ। গল্পকার হিসেবেও তিনি একজন সমাজদ্রষ্টা। এ গ্রন্থের প্রথম গল্প “ঘাড়ত্যাড়া বাচ্চু”। গল্পটিতে একজন মফস্বল সাংবাদিকের আপোষহীনতা ও ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার চিত্র চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সেই চিত্র ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে তিনি ধর্ম নিয়ে ব্যবসার দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন। যে পীরবাবা বালা মুসিবতের জন্য পানিপড়া দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক বনে গেছেন, সেই পীরবাবাকে নিজের চিকিৎসার জন্য যেতে হয় সিঙ্গাপুর। আর সেই প্রশ্ন উত্থাপন করে সর্বস্বান্ত হয় ঘাড়ত্যাড়া সাংবাদিক বাচ্চু। জেলে যাবার পথে তবুও তার প্রশান্তি কোনো পত্রিকায় এ সংবাদ না ছাপালেও ফেসবুকের মাধ্যমে সে অন্তত চরম সত্যটা সবাইকে জানাতে পেরেছে৷ এ গল্পে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের শক্তিময়তা প্রকাশ পেয়েছে।
দ্বিতীয় গল্প “ঠাডার” হালদা পাড়ের জেলেদের ঝুঁকিপূর্ণ জীবনের গল্প বলা হয়েছে। আমাদের দেশের মৎস্যজীবীরা ঘোর বর্ষায় কতটা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে আব্বাস তার প্রতিভূ। তার জন্মের দিন হালদা তার বাবাকে কেড়ে নিয়েছিল। তবুও সে হালদা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারেনি। আমরা সবাই জানি একটা বিশেষ মওসুমে হালদা নদীতে মা মাছেরা ডিম ছাড়ে। সেই সময় ঠাডার অর্থাৎ বজ্রপাতের প্রকোপ থাকে বেশি। ঘরে পোয়াতি বউ রেখে মায়ের নিষেধ অগ্রাহ্য করে আব্বাস যায় সেই ডিম সংগ্রহে। অনেক অনেক ডিম সংগ্রহ করে আব্বাস যখন লাখ টাকার স্বপ্নে বিভোর, ঠিক তখনই একটা ঠাডারে তার জীবন নিঃশেষ হয়ে যায়। উঠোনে যখন তার লাশ নামানো হয়, ঠিক তখনই তার বউ একটা পুত্রসন্তান প্রসব করে। বংশ পরম্পরায় দেখা যাবে একদিন এ ছেলেও হালদাকে বেছে নেবে তার জীবিকার উৎস হিসেবে।
“ছেলেটি সুস্থ হয়ে উঠেছিল” একটি মনোজাগতিক সংকটের গল্প। শিহাব নামের এক তরুণের একজন বিবাহিতা তরুণীর প্রতি আকর্ষণ এবং পরিণামে নির্মম মৃত্যু এ গল্পের উপজীব্য। শিহাবের ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিক সংকট দুর্বিষহ করে তুলেছিল মম–তন্ময়ের দাম্পত্যজীবন। শেষ পর্যন্ত শিহাবের উগ্র আচরণের জন্যই তাকে মরতে হয়েছে, কিন্ত তার প্রতি পাঠকের মন আর্দ্র হয়ে ওঠে যখন জানা যায় প্রেমিকার সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর শিহাব মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। মমর প্রতি তার দুর্নিবার আকর্ষণ মূলত তার মানসিক অসুস্থতারই বহিঃপ্রকাশ।
“সুনীলের কুকুরটা” চমৎকার একটি গল্প। যেখানে নায়ক সমকালীন যন্ত্রণায় কাতর হয়ে, মানুষকে এড়িয়ে একটা কুকুরের সাথে বন্ধুত্ব করেছে। প্রতিদিন রাতে কুকুরটা অপেক্ষা করে গল্পের নায়কের জন্য। নায়ক ফিরলে দুজন পুকুরঘাটে বসে নানা বিষয়ে আলাপ করে। সে আলাপে সাহিত্য চর্চাও চলে। এই কুকুর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার খবরও জানে। আলাপে আলাপে লেখক এখানে সমাজের কিছু চিত্রও তুলে ধরেছেন৷ এ গল্পে পরাবাস্তববাদ আছে। আসলেই কি কুকুরটা কথা বলে? নাকি কুকুরটা নায়কের অন্তর্নিহিত সত্তা!
“গল্পগুলো একই ধরনের” একটি হৃদয়স্পর্শী গল্প। বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেওয়া কয়েকজন বৃদ্ধের অসহায়ত্ব এ গল্পে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ছেলের হাতে মার খাওয়া, ডান হাত অসাড় হয়ে যাওয়া বৃদ্ধ যখন বানিয়ে বানিয়ে ছেলেকে মারার গল্প শোনায় তখন পাঠকের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।
“একটি মাদকতাহীন রাত” একজন মদ্যপের গল্প। যিনি পাঁড়মাতাল হয়েও ভাবেন মদ তাঁকে মাতাল করতে পারেনি। এ গল্পে লেখকের ব্যঙ্গরস পাঠককে আনন্দ দেয়।
“হাওয়াই মিঠাই” গল্পে গল্পকার সমাজের এক অন্ধকার দিককে তুলে এনেছেন। রাস্তায় বেরুলেই শত শত ভিখারি। তাদের কারো হাত নেই,কারো পা নেই,কারো চোখ অন্ধ। কারা ওদের এমন অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়েজিত করে তাদের স্বরূপ তুলে ধরেছেন কামরুল হাসান বাদল এ গল্পে। এ গল্প পাঠককে ধাক্কা দেয়।
এ গ্রন্থের শেষ গল্প “রহিমা”। রহিমা একটি রূপক গল্প। রহিমা নামের চরিত্রটি যেন আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। এ গল্প পাঠ করলে পাঠক সহজেই বুঝে যাবেন এর চরিত্রসমূহকে।
আগেই বলেছি, গল্পকার কামরুল হাসান বাদল একজন সমাজসচেতন লেখক। তাঁর এ গল্পগুলোতেও তিনি সমাজকে চিত্রিত করেছেন। তবে তাতে শিল্পহানি ঘটেনি। আশা করি গল্পগ্রন্থটি পাঠকপ্রিয়তা পাবে।
কামরুল হাসান বাদলের গল্পগ্রন্থ “সুনীলের কুকুরটা”। চমৎকার প্রচ্ছদের গল্পগ্রন্থটিতে গল্প আছে দশটি। প্রকাশক মঈন ফারুক, চন্দ্রবিন্দু। প্রচ্ছদও করেছেন মঈন ফারুক। মূল্য তিনশ টাকা।