এক বছরের ব্যবধানে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো থেকে পৌনে ৪ কোটি সুইস ফ্রাঙ্ক তুলে বা সরিয়ে নিয়েছেন বাংলাদেশিরা। সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের আমানতের পরিমাণ যেখানে ৫ কোটি ৫২ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক ছিল; ২০২৩ সালে তা কমে হয়েছে ১ কোটি ৭৭ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমানো অর্থের পরিমাণ ৬৮ শতাংশ কমে ২৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। খবর বিডিনিউজের।
বিশ্বজুড়ে ধনী ব্যক্তিদের টাকা সুইস ব্যাংকে রাখার আগ্রহের পেছনে মূল কারণ দেশটির গোপনীয়তার নীতি। সুইজারল্যান্ডের আইনে ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য নয়। টাকার উৎসও তারা জানতে চায় না। যদিও বিদেশি অর্থের তথ্যের গোপনীয়তার ক্ষেত্রে এখন ছাড় দিচ্ছে সুইজারল্যান্ড। কোন দেশের গ্রাহকদের কী পরিমাণ অর্থ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে জমা আছে, তার একটি ধারণা প্রতিবছর এসএনবির বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদের বাধ্যবাধকতা মেনে এসএনবি ওই তথ্য প্রকাশ করে। তবে সেখানে গ্রাহকের বিষয়ে কোনো ধারণা পাওয়া যায় না।
এসএনবি ২০২৩ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বৃহস্পতিবার। সেখানে দেখা যায়, ২৮ বছরের মধ্যে ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ ছিল আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ১৯৯৬ সালের পর বাংলাদেশির এত অর্থ কখনও জমা পড়েনি সেখানে। এর আগে ২০১৬ সালে রাখা ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ফ্রাঙ্ক ছিল সর্বোচ্চ; যদিও ১৯৯৬ সালে ছিল মাত্র ৩ কোটি ৮২ লাখ ফ্রাঙ্ক। সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অর্থের পরিমাণ প্রথমবার ১০ কোটি সুইস ফ্রাঙ্ক ছাড়িয়ে যায় ২০০৬ সালে, যেটি ছিল বিএনপি–জামায়াত জোট সরকারের শেষ বছর। নয় কোটি ৭২ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক থেকে বেড়ে ওই বছর জমার পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ কোটি ৪৩ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক। এরপর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম বছর ২০০৭ সালে জমা অর্থের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ২৪ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক হয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১১ সালে জমার পরিমাণ ছিল ১৫ কোটি ২৩ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক, তা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১৬ সালে তা ৬৬ কোটি ১৯ লাখে দাঁড়ায়। পরের বছর, অর্থাৎ ২০১৭ সালে তা কমে ৪৮ কোটি ১৩ লাখ সুইস ফ্রাঙ্কে নেমে এলেও ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের বছরে তা আবারও বেড়ে ৬১ কোটি ৭৭ লাখ সুইস ফ্রাঙ্কে দাঁড়ায়। দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাষ্য হল, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের যে টাকা জমা রয়েছে, তার ‘বেশিরভাগটাই অবৈধভাবে অর্জিত এবং বিদেশে পাচার’ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে সুইস ব্যাংকে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ কমার সঙ্গে বিদেশে অর্থ পাচার কমে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা। জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, সুইস ব্যাংকে অর্থ কমে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে অর্থ পাচার কমে গেছে; বরং অর্থ পাচার বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘সুইস ব্যাংকে আমানত কমে যাওয়ার কারণ হতে পারে দুটি। এক, দেশটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ দেশের বাণিজ্যিক অনেক ব্যাংকও বৈধ অর্থ জমা রাখে। সামপ্রতিক অর্থনৈতিক সংকট, অপ্রতুল ডলার ও রিজার্ভ কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য বাণিজ্যক ব্যাংক তাদের জমাকৃত অর্থ তুলে নিয়েছে। অন্যদিকে যারা পাচার করে অর্থ জমা রেখেছিল তারা তাদের অর্থ তুলে অন্য দেশের শেয়ার মার্কেট, রিয়েল এস্টেট ও বেশি মুনাফার সম্ভাবনা আছে এধন জায়গায় বিনিয়োগ করছে। যেহেতু, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট চলছে, তাই তারা এখন আর ব্যাংকে অলস অর্থ ফেলে রাখতে চাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে প্রচুর অর্থ এখন চলে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘যেসব দেশ গোপনীয়তা রক্ষা করছে, সেসব দেশে অর্থ পাচারের পরিমাণ বেড়েছে, আমরা সমপ্রতি লক্ষ্য করেছি। দুবাই ও সিঙ্গাপুরে প্রচুর বিনিয়োগ হচ্ছে। এখানে বাংলাদেশিরা অর্থ স্থানান্তর করে ব্যবসা করছেন। তাদের নিবন্ধিত কোম্পানিও রয়েছে।’
বিদেশি অর্থের তথ্যের গোপনীয়তার ক্ষেত্রে এখন ছাড় দিচ্ছে সুইজারল্যান্ড। কঠোর গোপনীয়তার প্রথার বাইরে গিয়ে এখন বিভিন্ন দেশের কর আদায়কারী সংস্থার সঙ্গে গ্রাহকের তথ্য বিনিময় করছে দেশটি। এমন তথ্য সরবরাহের প্রবণতার কারণেও জমাকারীরা তাদের গন্তব্য পরিবর্তন করছেন বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তার ভাষ্য, ‘অবশ্যই দেশের বাইরে অবৈধ অর্থ পাচার বেড়েছে। কিন্তু সুইজারল্যান্ড যেহেতু আন্তর্জাতিক চুক্তির আওতায় এসেছে এবং তারা পাচার হওয়া অর্থের তথ্য সরবরাহ করছে, তাই পাচারকারীরা তাদের গন্তব্য পরিবর্তন করে নিরাপদ জায়গায় বিনিয়োগ করছে।’