বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি এখনো থামেনি। ঘুমধুম ইউনিয়ন, কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন ও টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের সীমান্তের ওপারে গতকালও থেমে থেমে গোলাগুলি চলে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘাতে গুলি ও মর্টার শেল গতকাল মঙ্গলবারও এসে পড়েছে বাংলাদেশের ভিতরে সীমান্তবাসীদের ঘরে। এই পরিস্থিতিতে সীমান্তের বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সীমান্তের এক লাখের বেশি মানুষ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহিন ইমরান এবং বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন বলেছেন, ইতোমধ্যে তারা সংশ্লিষ্ট উপজেলার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। আপাতত নিরাপদ দূরত্বে স্কুল ও কমিউনিটি সেন্টারে তাদের রাখা হবে।
এদিকে গতকাল বেলা ১২টার দিকে বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, সর্বশেষ তথ্য মতে ২৬৪ জন আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে পালংখালী সীমান্ত দিয়ে এসেছে ১১৪ জন। এখানে শুধু বিজিপি সদস্য না, সেনাবাহিনীর সদস্য, কাস্টমস সদস্য ও আহত মিয়ানমারের সাধারণ নাগরিক রয়েছে। এ মুহূর্তে কতজন আহত রয়েছে বলা যাচ্ছে না। বিজিবি এদের হেফাজতে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে।
আশ্রয় নেয়া বিজিবির সদস্যদের মধ্যে অনেকে আহত রয়েছেন। তাদের বিজিবির তত্ত্বাবধানে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে এ পর্যন্ত ৯ জনকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৪ জনকে সোমবার রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) মো. আশিকুর রহমান।
সোমবার ঘুমধুমের জলপাইতলীতে মিয়ানমারের ছোড়া বোমার আঘাতে বাংলাদেশি নারীসহ দুজনের মৃত্যুর পর গতকাল ঘুমধুমের ডেকুবুনিয়া এলাকায় আরেক বাংলাদেশি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তার নাম সৈয়দ আলম। তিনি বলেন, আতঙ্কিত হয়ে স্ত্রী–সন্তানসহ বাড়ির সবাইকে কক্সবাজারে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম সোমবার। বাড়িতে গরু–ছাগল আছে, সেগুলোর জন্য আমি ও বাবা বাড়িতে ছিলাম। দুপুরের দিকে বাড়ির একটি গাছের সাথে গুলি লেগে আমার কপালের সাথে ঘষা খেয়ে চলে গেছে। আল্লাহ রক্ষা করেছেন। বাবা–ছেলে দুজন কক্সবাজার চলে এসেছি।
সীমান্তের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে ঘুমধুম–তুমব্রু সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন, পুলিশ সুপার সৈকত শাহীনসহ প্রশাসন, আইনশৃক্সখলা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পরিদর্শনকালে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদে আলোচনা করে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো থেকে লোকজনদের নিরাপদ আশ্রয়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে তিনি বলেন, সীমান্তের সার্বিক পরিস্থিতি উত্তেজনাকর। পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রাথমিক অবস্থায় ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দাদের নিরাপদে আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে। ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন বলেন, সীমান্তবর্তী গ্রামের মানুষদের নিরাপত্তায় জনপ্রতিনিধিদের সাথে কাজ করছে পুলিশ। আতঙ্কিত না হয়ে বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে আইনশৃক্সখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছে পুলিশ।
স্থানীয় ইউপি সদস্য দিল মোহাম্মদ ও আনোয়ার জানান, সীমান্তে বাংলাদেশিরা উদ্বেগ–উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর মানুষ। ইতোমধ্যে তুমব্রু বাজারপাড়া, মাঝেরপাড়া ও কোনাপাড়া গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়েছে। সীমান্তবর্তী বন্ধ করে দেয়া ৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে অনেকে।
পালংখালী ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশের দায়িত্বে থাকা নুরুল আমিন বলেন, দিনে একটু স্বস্তিতে থাকলেও সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মিয়ানমারের ছোড়া মর্টার শেল ও গুলির শব্দে মনে হয় যেন মাটি দেবে যাচ্ছে। এই আতঙ্কে এলাকার মানুষের চোখে ঘুম নেই।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের সচিব এরশাদ উল্লাহ হক বলেন, সীমান্ত এলাকায় গোলাগুলি থেমে নেই। ঘুমধুম ইউনিয়নের একেবারে সীমান্তঘেঁষা বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলা হচ্ছে। সীমান্তঘেঁষা গ্রামগুলো হলো তুমব্রু কোনারপাড়া, তুমব্রু মাঝেরপাড়া, ভাজাবনিয়া পাড়া, তুমব্রু বাজারপাড়া, চাকমা হেডম্যান পাড়া, তুমব্রু পশ্চিমকূল পাড়া, ঘুমধুম নয়াপড়া, ঘুমধুম পূর্বপাড়া ও ঘুমধুম মধ্যমপাড়া। মূলত এসব পাড়ার বাসিন্দাদের মাইকিং করে সরে যেতে বলা হচ্ছে। এসব পাড়ায় আনুমানিক ২০০ পরিবার রয়েছে বলে জানান তিনি।