পরিবার ও সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতা আর বাধাকে ডিঙ্গিয়ে বিস্তর সংগ্রাম আর লড়াই করে নিজেকে অপরাজিতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন সীতাকুণ্ডের অদম্য নারী বিবি গোল জান্নাত। জান্নাতের পিতার নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল মনসুর (প্রয়াত)। মায়ের নাম বিবি খাদিজা। তিনিও প্রয়াত। ১৯৯৩ সালের ১৭ জানুয়ারি জান্নাতের জন্ম হয়। তখন তাঁর পিতা সরকারি চাকুরে ছিলেন।
ফলে অনেকটা সোনার চামচ মুখে নিয়েই জান্নাত বেড়ে উঠছিলেন। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস! জান্নাত যখন দশম শেণির ছাত্রী তখন হঠাৎ পিতার মৃত্যু হলেই তাদের সুখের সংসারে বিপর্যয় নেমে আসে। শুরু হয় জীবনের কঠিন ও করুণ এক অধ্যায়ের। সামনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা। অথচ ফরম ফিলাপ করার সামর্থ্যটুকুও নেই। জান্নাতের স্কুলের হেড টিচার জসীম উদ্দীন সেদিন যদি টাকা যোগাড় করে দিয়ে সহযোগিতার হাত না বাড়াতেন, তাহলে বিবি গোল জান্নাত কোনদিনও ম্যাট্রিক পাস করতে পারতেন না। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর থেকে শুরু হয় জান্নাতের জীবন সংগ্রাম। এই ছোট্ট মেয়েটি দিনে তিনটি চাকুরী করেন শুধুমাত্র লেখাপড়া করে বেঁচে থাকার তাগিদে।
দুটি এস জিও স্কুলে এবং বোর্ড অফিসে কম্পিউটার সেকশনে। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চাকরি করে রাতে বাড়ি ফিরে আবার পড়াশোনা করা! কি অপরিমেয় প্রচেষ্টা, একটি মিনিটও সময় নষ্ট না করে, কাজ আর কাজ, সেই সাথে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার আগ্রহ আর নিজের আত্মবিশ্বাস। আমাকে পারতেই হবে, আমি পিছিয়ে থেকে সমাজ পরিবারে গলগ্রহ হতে চাই না। এই কষ্ট আর সংগ্রামের মাঝেও ভালো একটি রেজাল্ট নিয়ে পাসও করে ফেলে বিবি গোল জান্নাত। এবার মোস্তফা হাকিম কলেজে ভর্তি হলেন একাদশ শ্রেণিতে।
কিন্তু ‘বিয়ে’ নামের সামাজিক বন্ধনের যন্ত্রণায় এই কিশোরীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। সবার মুখে যেন একটিই কথা, মেয়ে বড় হয়েছে, পড়াশোনার কি দরকার এখন বিয়ে দিয়ে দাও। জান্নাতের স্বপ্ন ছিল সাংবাদিক হওয়ার। কিন্তু পরিবারের কড়া নির্দেশের কাছে স্বপ্ন হার মানে। ইন্টার পাস করার পরই তাঁকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। তারই গ্রামের এক ছেলের সাথে তাঁর বিয়ে সম্পন্ন হয়। জান্নাতের মুখেই শোনা, তিনি স্বামী হিসাবে যাকে পেয়েছিলেন তিনি নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। জান্নাতের পড়ালেখার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ দেখে স্বামী তার পরিবারের অমতকে উপেক্ষা করেই জান্নাতকে ডিগ্রিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। পরিবারে নানান কথা তাঁর স্বামীকে শুনতে হয়েছে। বিয়ের পরে আবার কিসের পড়া? বিয়ে হয়ে গেলে পড়তে নেই। সংসারের কাজই করতে হবে। এসবকে পাত্তা না দিয়ে তিনি বলেন, কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমার নেই। ফলে স্বামীর একচ্ছত্র সহযোগিতায় ২০১৩ সালে জান্নাত ডিগ্রি পাস করেন। এরই মাঝে তিনি এক সন্তানের জননী হন। ডিগ্রি পাস করার পরে পরিবারের অন্যরা তাঁর এই সাফল্য আর অর্জনকে ভালো চোখে দেখলেন না। আবার নানান নেতিবাচক মন্তব্য করতে থাকে। ঘরের বৌদের এতো পড়ালেখার কি দরকার, বেশি
লেখাপড়া করলে মাতব্বর হয়ে যাবে এসব বলতে থাকে। কিন্তু যার আছে অদম্য ইচ্ছে আর পড়ালেখার বাসনা, সে–তো থামতে পারে না। প্রবহমান নদীর মতোই জান্নাত এগিয়ে চলে সামনের দিকে, আর পাশে আছে তাঁর কাণ্ডারী স্বামী। জান্নাত এবার ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম কলেজে অর্থনীতি নিয়ে এম এ ক্লাসে ভর্তি হন। তখন তাঁর কোল জুড়ে আসে আরেক পুত্র সন্তান।
২০১৫ সালে জান্নাত প্রথম ইউপি নির্বাচনে অংশ নেন। এ সময় জয়ী হয়েও ষড়যন্ত্রের কাছে তিনি হেরে যান। তখন জান্নাত যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডে মহিলা সম্পাদিকা হিসাবে। সেই সাথে মাস্টার্সের পড়াশোনা এবং বিভিন্ন সামাজিক কাজে নিজেকে তিনি নিয়োজিত রাখেন। ২০১৬ সালে জান্নাত মাস্টার্স পাস করেন। তখন একটি বেসরকারি ব্যাংকে তাঁর চাকুরি হলেও তিনি স্বামীর অনুরোধে সেই চাকুরি ছেড়ে দেন।
তখন স্বামী তাকে ভর্তি করিয়ে দেন ডিপ্লোমা ইন প্যারামেডিক্স এ। ২০২০ সালে জান্নাত প্যারামেডিক্স পাস করেন। করোনাকালে জান্নাত আন্দরকিল্লাহ জেনারেল হাসপাতালে ইন্টার্নশীপ সম্পন্ন করেন। সে সময় তিনি সাহসী যোদ্ধার মতোই মানুষের সেবা করেছিলেন। ২০২২ সালে তিনি আবার নির্বাচন করে একই ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হলে তিনি নির্বাচনে যা টাকা খরচ করবেন, সেই টাকা দিয়ে নিজেই একটি নার্সিং চেম্বার চালু করেন। চেম্বারে নিয়মিত মানবসেবা দিয়ে তিনি সম্মান এবং জনপ্রিয়তা দুটোই অর্জন করেন। এখন জান্নাত অনেকটা প্রতিষ্ঠিত। তাঁর একটি ফার্মেসি এবং একটি কোচিং সেন্টার রয়েছে। জান্নাত অপরাজিতা নেটওয়ার্কে যুক্ত হলে নারী নেত্রী সুরাইয়া বাকের–এর হাত ধরে প্রথম রাজনীতিতে অভিষিক্ত হন। তিনি সীতাকুণ্ড উপজেলা মহিলা শ্রমিক লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। জান্নাত বলেন, এক সময়ের কঠিন সংগ্রামকে এখন আর কোনো কষ্টই মনে হয় না। মনে হয় প্রতিটি শ্রম আর কষ্টের পেছনে লুকিয়ে ছিল সাফল্যের হাতছানি। একেবারে রূপকথার গল্পের মতোই যেন সাফল্যের রথে চড়ে জান্নাতের অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাবার ইতিহাস। এই অপরাজিতার জন্য শুভকামনা নিরন্তর।