সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুরোদেশে একধরণের শোকাবহ পরিস্থিতি বিরাজমান। আগুনের কারণে সাম্প্রতিককালে এর চেয়ে বড় কোনো ট্র্যাজেডি আমরা দেখিনি যাতে এত বড় বিস্ফারণ ও এত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে এরই মধ্যে আশপাশের গ্রামের ছয়টি পুকুরের পানি শেষ হয়ে গেছে। প্রায় অর্ধশত মানুষের মৃত্যু ও চারশতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। আমরা দেখেছি ২০২০ সালেও চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় একটি কন্টেইনার ডিপোতে একটি তেলের ট্যাঙ্ক বিস্ফোরণে তিনজন নিহত হয়েছিল এবং গত বছরের জুলাই মাসে রাজধানী ঢাকার বাইরে একটি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মধ্যে আগুন লাগার ঘটনায় ৫৪ জন মারা গিয়েছিল।
আগুনের উৎপত্তি হয় প্রাকৃতিক বা মানুষ সৃষ্ট কারণে। আমাদের দেশে দ্বিতীয়টা প্রধান। আগুনের ভয়াবহতা বিশেষ করে কারখানা এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে সমুদয় উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিতে পারে। এর কারণে গুরুতর আহত হবার এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও যে ঘটতে পারে তা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। তারপরও যে কোনো মূল্যে মানসম্মত ও উন্নত ডিজাইন ও উপকরণ ব্যবহার করে কারখানায় অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুঁকি শুন্য পর্যায়ে নিয়ে আসা এবং জান মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে অগ্নিনির্বাপণ নীতিমালা প্রণীত আছে। নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, সম্পদের সুরক্ষা ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার লক্ষ্যই এই নীতিমালা। যতদূর জানা যায় বিএম কন্টেইনার ডিপো নেদারল্যান্ডস এবং বাংলাদেশের যৌথ পরিচালনায় চালিত একটি প্রতিষ্ঠান। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপোগুলোর অন্যতম। সীতাকুণ্ডেই এরকম তিনটি বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো রয়েছে। এখানে ৪৩০০ গাড়ি বা কন্টেইনার রাখার সক্ষমতা রয়েছে। আগুন লাগার সময় রপ্তানির উদ্দেশ্যে রাখা প্রায় দেড় শতাধিক কন্টেইনার ছিল এই ডিপোতে। অতএব এতে যে কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা যথাযথ থাকার কথা। তারপরও কেন এ ভয়াবহতা? অগ্নিনির্বাপণে ব্যবহার্য জিনিষের সঠিক ব্যবহার এবং এসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও গুরুত্বপূর্ণ। আগুনের সূত্রপাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু বিস্ফোরণটা হয়নি। কেননা, বিস্ফোরণের অবস্থায় পৌঁছাতে বেশ কিছুটা সময় দরকার হয়। অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা থাকলে ওই সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। কন্টেইনার ডিপোটাতে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থায় অনেক ধরনের দুর্বলতা ছিল বলে মনে হয়। ব্যবস্থা থাকলেও এর সঠিক ব্যবহার জানে এমন মানুষের অভাব ছিল। সে কারণেই আগুন নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় চলে গেছে।
পত্রপত্রিকা মারফত জানা যায়, ডিপোতে বেশ কিছু হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের কনটেইনার ছিল। হাইড্রোজেন পার-অঙাইড সাধারণ অবস্থায় দাহ্য নয়। এটা অগ্নিসহায়ক রাসায়নিক হিসেবে কাজ করে। হাইড্রোজেন পারক্সাইড খুব সহজে বিযোজিত হয়ে পানি ও অঙিজেনে পরিণত হয়। সাধারণত বস্ত্রশিল্পসহ বিভিন্ন শিল্পে এটি ব্যবহার করা হয় বিরঞ্জক হিসেবে। কোনো কিছুর স্থায়ীত্ব বজায় রাখার জন্য স্টেবিলাইজার হিসেবে এটিকে অন্য একটি কেমিক্যাল এর সাথে মিশ্রিত করা হয়। এটি উচ্চ তাপে বয়লিং তাপমাত্রা অতিক্রম করলে এটা বিস্ফোরক হিসাবেও আচরণ করতে পারে। হাইড্রোজেন পার অঙাইডের কারণে কোনো আগুন লাগলে সেটি পানি দিয়ে নেভানো যায় না। ফগ সিস্টেমে এ ধরনের আগুন নেভানো সম্ভব। এছাড়াও ফোম বা ড্রাই পাউডার জাতীয় অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র দিয়ে এমন আগুন নিভানো যায় বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
সীতাকুণ্ডের আগুন নেভানোর কাজ তদারকিতে ছিলেন দমকল বাহিনীর এমন একজন পরিচালকের বক্তব্য থেকে জানা যায়, ডিপো কর্তৃপক্ষ তাদের ফোন করেনি। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে টেলিফোন পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আশপাশের কেন্দ্র থেকে আগুন নেভাতে ছুটে যান। ডিপোতে বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণ হয়েছে। শুধু একটা বিস্ফোরণ ছিল না। কিছুক্ষণ পর পর থেকে থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে। আগুন যখন একটা কন্টেইনার থেকে আরেকটা কন্টেইনারে গিয়ে লাগছিল তখন একটা একটা করে বিস্ফোরণ হচ্ছিল। উনার মতে, ফায়ার সার্ভিস বাহিনীর প্রথম যে সদস্যরা গিয়েছিলেন তাঁদের ধারণা ছিল, কনটেইনারের ভেতর পোশাকসহ অন্যান্য মালামাল রয়েছে। সেখানে যে কেমিক্যাল ছিল, এই আইডিয়া তারা পাননি। তাই শুরুতেই তারা যখন অগ্নি নির্বাপণ করতে গিয়েছিলেন, তখন ওই বিস্ফোরণ হওয়ার কারণে তাঁদের বেশ কয়েকজন সদস্য নিহত হন। উনারা যদি শুরুতেই জানতে পারতেন যে, এখানে কেমিক্যাল বা হাইড্রোজেন পারঅঙাইড ছিল, তাহলে সেভাবে প্রস্তুতি নিতে পারতেন। কেমিক্যালের কারণে সংঘটিত ফায়ার কন্ট্রোলিং যে সরঞ্জামাদি রয়েছে, সেগুলো নিয়ে এঙপার্টরা সেখানে যেতে পারতো।
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় মনে হয় কারখানা ম্যানেজমেন্টের সাথে জড়িত লোকজন অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে জরুরি যেসব পদক্ষেপ যতটুকু নেওয়া দরকার ছিল, ততটুকু নেয়নি। সেখানকার শ্রমিক ও অন্যান্য লোকজনকে যেভাবে বের করে আনা দরকার ছিল, সেটাও করা হয়নি বলে মনে হয়েছে। সম্প্রচারিত ফেসবুক লাইভে দেখা যায় আগুন লাগা স্থানের খুব কাছেই উৎসুক জনতা ভিড় করছিল, ছবি তুলছিল, ভিডিও করছিল বা লাইভ সম্প্রচার করছিল কাছে দাঁড়িয়ে, ডিপোর কর্মচারীরাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিল এ দৃশ্য অনেকটা নিরুপায় হয়ে। এ কারণে এত হতাহত হয়েছে। লাইভ সম্প্রচার করা ছেলেটিও নিহত হয়। ডিপোতে যদি পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকত, তাহলে শুরুতেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যেত। সেটা করা গেলে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটত না। যদি অগ্নিনির্বাপণ এবং লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার নিয়ম মেনে চলা হতো, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা এড়ানো যেত বলে মনে হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকপূর্ণ কনটেইনার একটার পর একটা যেভাবে রাখা হয়েছে, সেটা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। কনটেইনার রাখার একটা আন্তর্জাতিক গাইডলাইন আছে। ডিপোতে থাকলেও আলাদা জায়গায় এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কনটেইনার রাখতে হবে। অন্যান্য পণ্যবাহী কনটেইনার থেকে আলাদা করে রাখতে হবে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে বিপজ্জনক পণ্য ও রাসায়নিক রাখার জন্য আলাদা শেড আছে। সীতাকুণ্ডের ডিপোটাতে এটা মেনে চললে ফায়ার সার্ভিস আগুনটাকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে রাখতে পারত। সেটা ছড়িয়ে পড়ত না। সম্প্রতি খবরে দেখলাম বন্দরে রক্ষিত অনেক দিনের পুরানো খালাস না হওয়া হাইড্রোজেন পারঅঙাইড এর একটি চালান তড়িঘড়ি করে নিলাম করা হচ্ছে। আমরা বরাবরই ঘটনা ঘটার পর সতর্ক হই। চট্টগ্রামের বিস্ফোরক পরিদপ্তর এর বক্তব্য অনুযায়ী, ওই ডিপোতে দাহ্য পদার্থ রাখার বিষয়টি তাদের জানানো হয়নি। এ ধরনের পণ্য সংরক্ষণে বিশেষ ধরনের অবকাঠামো দরকার, কিন্তু ওই ডিপোতে সে ধরনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। অনুমোদন না নিয়ে ডিপোতে কেমিক্যাল রাখা হয়েছিল।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায়, ঢাকার জনবহুল ভবন বিশেষ করে হাসপাতাল, শপিং মল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দুই হাজার ৬১২টি ভবনের মধ্যে মাত্র ৭৪ টির অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রয়েছে। বাকি সবকটি ভবন অর্থাৎ দুই হাজার ৫৩৮টি ভবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জরিপে উঠে আসে। ঢাকার অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত বনানীতে কেনাকাটার জন্য বেশ জনপ্রিয় বনানী সুপার মার্কেট। ভবনটিতে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলে প্রায় কিছুই নেই। একই ধরণের একটি জরিপ চুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ থেকে করা হয়েছে গবেষণার জন্য। উক্ত বিভাগের প্রধান ও গবেষণা সুপারভাইজার ড. রাশিদুল হাসানের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলাম। উনার মতে ‘আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে গত ৫ বছরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৯টি ফায়ার স্টেশনের তথ্য অনুযায়ী ২৫০০ এর মতো অগ্নি-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর মূল কারণ ছিল বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, চুলা ও বিড়ি-সিগারেটের আগুন। ফায়ার সার্ভিসের লোক সময়মতো পৌঁছালেও ক্ষতিটা বেশী হয় মূলত যথেষ্ট পানির যোগান দিতে না পারার কারণে। আমরা প্রাকৃতিক পানির উৎসসমুহ ক্রমেই ধ্বংস করার কারণে এটি হচ্ছে’।
এ ধরনের অগ্নি দুর্ঘটনা থেকে রক্ষার জন্য কন্টেইনার ডিপোগুলোর ক্ষেত্রে যে আন্তর্জাতিক গাইডলাইন আছে তা মেনে চলা উচিত বলে মনে করি। বেসরকারি ডিপোগুলো সেটা মেনে চলছে কি না, তা তদারকির কর্তৃপক্ষ কে, সেটা এখন একটা বড় প্রশ্ন। প্রতিটি ডিপোকে গাইডলাইনের আওতায় আনা জরুরি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, বিস্ফোরক পরিদপ্তরের মতো তদারকি কর্তৃপক্ষের যারা আছেন, তাদের নজরদারি বাড়ানো ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।
সীতাকুণ্ডে অগ্নি দুর্ঘটনায় সৃষ্ট মানবিক সংকটে সব পেশার লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবধরণের মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে তা সত্যিই উল্লেখ করার মতো। ফায়ার সার্ভিস, সেনা, আনসারসহ সরকারি সকল বিভাগের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। আরও এসেছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, যুবকসহ নানা পেশার মানবিক মানুষগুলো। আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে, বিপদে মানুষের এগিয়ে আসার যে গৌরব তা আবারো প্রমাণিত হলো। এ মানবিক সংগঠন ও মানুষগুলো, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে সবসময় থাকে এবং থাকবে।
বিশেষ করে ধন্যবাদ দিতে হবে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে, যারা নিজেদের সবটুকু বিলিয়ে দিয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একগ্রুপ ছাত্র ও রক্ত দেওয়ার জন্য গভীর রাতেই মেডিকেলে চলে আসে ট্রাকে বাসে করে। ডিপো এলাকায় অগ্নি নির্বাপণ থেকে মেডিকেলে রক্ত দেয়া, ঔষধ জোগাড় করা, আহতদের সেবা, শুশ্রূষা, সবকিছুতেই এগিয়ে এসেছেন এই তরুণ প্রজন্ম। এ মানবিক তরুণরাই আগামীতে সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিবে এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : প্রফেসর, বিভাগীয় প্রধান, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।