দ্বিতীয় টেস্টের চতুর্থ দিনেই খেলা শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মুখে ছিল সিরিজ জয়ের উল্লাস। অন্যদিকে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ক্যারিবিয়ানদের মুখে ছিল সিরিজ হারের বেদনা। অথচ দু’দলের টেস্ট সিরিজ শেষ হয়েছে সমতায়। ম্যান অব দ্যা সিরিজ যৌথভাবে দুজন। বাংলাদেশের তাসকিন আহমেদ এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের জেডেন সিলসর। কিন্তু দু’জনের মুখের অভিব্যক্তি ছিল দু’রকমের। তাসকিন হাসছিলেন আর সিলসের মুখ গুমোট হাওয়া। সিরিজ জয়ের ট্রফি নেওয়ার সময়ও দেখা মেলে একই দৃশ্য। একসঙ্গে ট্রফি গ্রহণ করলেও মেহেদী হাসানের মুখে ঝলমলে হাসি, ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েটের চেহারায় রাজ্যের আঁধার। ড্র হওয়া সিরিজেও যে কখনও কখনও জয়–পরাজয় থাকে, সেটিই যেন ফুটে উঠল এই দৃশ্যগুলোয়। যে সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হয়েছিল দিন, সেটিকে পূর্ণতা দিয়েই দিনের শেষে প্রাপ্তিটুকু আদায় করে নিল বাংলাদেশ। জ্যামাইকা টেস্টে নিজেদের রাঙাল ১০১ রানের স্মরণীয় এক জয়ে। ১৫ বছর পর আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজে ধরা দিল টেস্ট জয়। আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের বর্তমান চক্রও তারা শেষ করতে পারল জয় দিয়ে।
জয়ের ভিত আগের দিনই গড়ে ফেলেছিল বাংলাদেশ। চতুর্থ দিনে মঙ্গলবার দলকে বলতে গেলে একাই টেনে নেন জাকের আলি। তার ৯১ রানের ইনিংসের সৌজন্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৮৭। কিন্তু তাদের ইনিংস গুটিয়ে যায় ১৮৫ রানেই। ৫০ রানে ৫ উইকেট শিকার করেন তাইজুল। ম্যাচে ৬ উইকেটের পাশাপাশি ব্যাট হাতে দুই ইনিংসেই অবদান রেখে ম্যান দ্যা ম্যাচও তিনিই। সকালে ৫ উইকেটে ১৯৩ রান নিয়ে দিন শুরু করে বাংলাদেশ। আগের দিনের দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান জাকের ও তাইজুল আরেকটু এগিয়ে নেন দলকে। কার্যকর এক বাউন্সারে তাইজুলের প্রতিরোধ ভেঙে এই জুটি থামান আলজারি জোসেফ। আগের দিন অসুস্থতার কারণে ব্যাট করতে না পারা মোমিনুল হক অবশেষে ব্যাটিংয়ে নামেন আট নম্বরে। প্রথম ইনিংসের মতোই আউট হয়ে যান কোনো রান না করেই। বাংলাদেশের রান তখন ৭ উইকেটে ২১১। জাকের খেলছেন ৭২ বলে ৩৯ রান করে। জোড়া উইকেট হারানোর পর নিজের করণীয় বুঝে নেন জাকের। তৃতীয় টেস্ট খেলতে নামা ব্যাটসম্যান দারুণ পরিপক্কতার পরিচয় দিয়ে স্কিল আর পেশির জোরের প্রদর্শনী মেলে রান বাড়াতে থাকেন ঝড়ের বেগে। চার–ছক্কার স্রোতে ভেসে সেঞ্চুরির সম্ভাবনাও জাগিয়ে তোলেন তিনি। ৮ চার ও ৫ ছক্কায় ১০৫ বলে ৯১ রানের ইনিংসটি বাংলাদেশের স্বপ্নের পালে জোর হাওয়া দেয়।
এই মাঠে ২১২ রানের বেশি তাড়া করে জয়ের নজির নেই। সেখানে ২৮৭ রানের লক্ষ্য তো অনেক বেশিই। ওয়েস্ট ইন্ডিজও পারেনি নতুন ইতিহাস লিখতে। আক্রমণে এসেই বাংলাদেশকে প্রথম উইকেট এনে দেন তাইজুল। ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক ক্রেইগ ব্যাথওয়েট অবশ্য বেশ ইতিবাচক শুরু করেন। স্বভাববিরুদ্ধ পথে হেঁটে আগ্রাসী কিছু শট খেলেন তিনি। ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে ছক্কা মারেন তাইজুলকে। বাঁহাতি এই স্পিনার পরে ঠিকই শোধ তোলেন। তীক্ষ্ণ টার্ন ও বাউন্সে ৪৩ রানে বিদায় নেন ব্র্যাথওয়েট। কেসি কার্টিকে ফেরান তাসকিন আহমেদ। পরে তাইজুলের বিশাল টার্ন করা ডেলিভারিতে বোল্ড হন আলিক আথানেজ। কাভেম হজকে ৫৫ রানে থামান তাইজুল। জশুয়া দা সিলভাকে ফিরিয়ে তাইজুল পূর্ণ করেন পাঁচ উইকেট। টেস্ট ক্যারিয়ারে এই স্বাদ পেলেন তিনি পঞ্চদশবার। হাসান মাহমুদ এক ওভারেই দুটি শিকার ধরে নেন। শামার জোসেফকে দারুণ ইয়র্কারে বোল্ড করে ম্যাচের ইতি টানেন নাহিদ রানা।
প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ মাত্র ১৬৪ রান করার পরও লিড পেয়েছিল এই নাহিদের দারুণ বোলিংয়ে। তার হাত ধরে ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু, তার হাত দিয়েই জয়ের পূর্ণতা। মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জয়, আরও আগে দেশের শততম টেস্টে শ্রীলংকায় জয় কিংবা এই বছরে পাকিস্তানে দুটি জয় হয়তো এখনও ওপরেই থাকবে। তবে নিয়মিত অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত ও অভিজ্ঞতম ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিমকে ছাড়া এই জয়, প্রথম টেস্টে হেরে কোণঠাসা হয়ে পড়া অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে এই জয়ও বিশেষ কিছু। দেশের ক্রিকেটে ছোটখাটো একটি রেকর্ডও হয়েছে এই জয়ে। এই প্রথম এক পঞ্জিকাবর্ষে দেশের বাইরে তিনটি টেস্ট জিততে পারল বাংলাদেশ। টেস্ট সিরিজ শেষে এবার ওয়ানডের লড়াই। সেন্ট কিটসে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ শুরু আগামী রোববার।