“চোখের শিক্ষিত-অশিক্ষিত বলে ব্যাপার আছে। অশিক্ষিত চোখ কেবল তাকায়, দেখে না। দেখতে হলে চোখকে দেখার জন্যে প্রস্তুত করে তুলতে হয়। এই চোখ শারীরিক নয়; পিট পিট করে, কেতুর জমে কিংবা ছলো ছলো জল ঝরিয়ে দেয় যে, সেও নয়!”
কালো হরফে ছাপা বাক্যগুলো পড়ছিলাম ২০২২ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত তানভীর পিয়ালের ‘সিনেমা দেখার চোখ’ বইটি থেকে। চন্দ্রবিন্দু কর্তৃক প্রকাশিত এ বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন রাজীব দত্ত।
সিনেমা নিয়ে মূল্যায়নধর্মী এ বইয়ে নামপ্রবন্ধসহ মোট এগারটি লেখা (লেখকের ভাষায় সাড়ে দশটি)। এ বই প্রকাশসূত্রে এক আলাপচারিতায় উঠে এসেছে লেখক তানভীর পিয়ালের মনোভাবনা ও চলচ্চিত্র শিল্পের নানা দিক। আগ্রহী পাঠকেদের উদ্দেশে এখানে তুলে ধরা হলো তার বিশেষ অংশগুলো।
আপনার বইয়ের ভূমিকায় অপুর সংসার, আফসোস আর সত্যজিৎ রায় পড়ে মনে হতে পারে সেই তো পুরনো মদ, কিন্তু শেষ আফসোসে গিয়ে বোঝা যায় প্রসঙ্গের আলোচনা কতোটা ব্যপ্তি ছড়িয়ে সিনেমা দেখার গুরুতর দিকগুলো তুলে ধরে। তবে এক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায়কে দিয়েই কেন?
প্রথমত, সত্যজিৎ আমার প্রিয়; দ্বিতীয়ত, সত্যজিৎ জনপ্রিয় বলে। ফেসবুকে অপুর সংসার-এর নানা দৃশ্য কাটপিস হিসেবে ঘুরে বেড়ায়, লোকে খুব পছন্দ করে সেসব, নিশ্চয় কানেক্টও করতে পারে, তাই ভাবলাম, কাজে লাগাই। আর, আমার বক্তব্যের সাথেও তো বিষয়টা প্রাসঙ্গিক, বা অন্তত প্রাসঙ্গিক করে তোলার সুযোগ তো ছিলোই। অপু-অপর্ণার অনুশোচনা ও আফসোস সংক্রান্ত কথাগুলো দিয়ে শুরু করায় লাভ যেটা হলো, সেই আফসোসের রেশ টেনে আমার ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা নিয়ে প্রত্যাশার কথা বলে লেখাটা শেষ করতে পারলাম। পৃথিবীর আবর্তনের মতো, কিংবা সঙ্গীতের মতো বলতে পারো। সা-তে শুরু হয়ে যেমন সা-তে এসে শেষ হয় সুর, তেমনই।
‘সত্যজিতের বইটি এখনো প্রাসঙ্গিক তবে সত্যজিৎ আর নন’- বইতে এমন উক্তির বিষয়ে বিস্তারিত যদি বলেন-
আমি জানতাম আমাকে কেউ না কেউ এ প্রশ্নটি করবে। বইতে লাইনটি মূলত ছিলো ‘সত্যজিতের বইটি তাই আজও প্রাসঙ্গিক, যতোটা সত্যজিৎ নিজে আর নন’। এতে যতোটা শব্দটি আছে। সত্যজিৎ অসাধারণ নির্মাতা, এতে সন্দেহ নেই। তার প্রাসঙ্গিকতা-অপ্রাসঙ্গিকতা, মূল্যায়ন প্রধানত নির্মাতা হিসেবেই। তার প্রতিটা সিনেমাতেই শেখার মতো, বিস্মিত হওয়ার মতো অনেক কিছুই রয়েছে, কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে তার সব সিনেমা আর সেই গুরুত্ব ধরে রাখতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না। কাঞ্চনজঙ্ঘা, হীরক রাজার দেশে কিংবা জনঅরণ্য-এর মতো কয়েকটি সিনেমা নির্মাণ, বিষয়গত উৎকর্ষতার গুণে আজকের দিনেও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ বা দর্শকের তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম। কিন্তু তার তিন কন্যা, দেবী, অভিযান বা শাখা-প্রশাখা-এর মতো সিনেমাগুলো আজকের দিনের দর্শককে টানছে বলে মনে হয় না। সত্যজিৎ পুরোপুরিভাবেই একজন স্টোরিটেলার। কিন্তু আজকের দর্শকের কাছে সিনেমার গল্পের চাহিদা বদলে গেছে। সিনেমার কাছে দর্শকের চাহিদা বদলে গেছে। ফলে, সত্যজিৎ প্রাসঙ্গিক নন তা নয়, তবে তার অনেক সিনেমাই আজ আর সমানভাবে আলোচিত নয়। কিন্তু সিনেমা নিয়ে তার বইটা আজকের দিনেও দর্শকের বা পাঠকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বইটা সিনেমার ইতিহাসের যে পর্যায়ে লেখা, সিনেমা আজ আর সেখানে নেই। তবে সিনেমার একটা বেসিক আইডিয়া সে বইতে আছে, যা চিরন্তন। এ জন্যই বলছি, বইটা যতোটুকু প্রাসঙ্গিক, সত্যজিৎ নিজে আর ততোটা নন।
‘সিনেমা দেখার চোখ’ বইটির ভূমিকায় দেখা যায় দর্শককে বেশ প্রাধান্য দিয়েছেন। সিনেমা কি তাহলে কেবল দর্শকের?
যে দেখবে তার জন্যে তো অবশ্যই। সিনেমা বানানোই হচ্ছে কেউ না কেউ দেখবে বলে। পরিচালক যখন এটি বানাচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত এটি তার, মুক্তি দেয়ার পর তা দর্শকের। মুক্তি দেওয়ার অর্থ কিন্তু অধিকার ছেড়ে দেওয়া। তখনই সিনেমার যথার্থতা-অযথার্থতা প্রতীয়মান হতে থাকে। সমস্যা হলো, সিনেমা বা যে কোন আর্টফর্ম সম্পর্কে যে কেউই মতামত দিয়ে ফেলতে পারে। ধরো, হিরোশিমা মন আমুর দেখে যে কেউ বলতে পারে এটা কিছুই হয়নি। কিংবা ধরো, হিন্দি মম সিনেমাতে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী ও শ্রীদেবীর একটা দৃশ্য আছে। তারা এক চিত্র প্রদর্শনীতে বেশ বড় ক্যানভাসের একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। শ্রীদেবী সেই ছবিটা সম্পর্কে বলে, এতে প্রতিশোধের সবচেয়ে বড় গল্প মহাভারতকে তুলে ধরা হয়েছে। নওয়াজুদ্দিন সেই ছবি দেখে মন্তব্য করছে, এটা তো সে পানের পিক ছিটিয়েই বানাতে পারে! তো, আর্টের জাজমেন্ট সাধারণের স্তরে প্রায়ক্ষেত্রে এরকমই। নওয়াজুদ্দিনের ঐ চরিত্রের অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আর্ট মূল্যায়নের মতো চোখ ছিলো না। ফলে সে আর্টকে বিচার করছে তার জায়গায় দাঁড়িয়ে।
প্রতিটা আর্ট ফর্মই বিবর্তিত হচ্ছে। যেমন, কবিতা এখন আর রবীন্দ্র-নজরুলের যুগে পড়ে নেই। ফলে, কেউ যদি কবিতা বলতে স্কুলের পাঠ্যবইয়ের সেই সব কবিতাতেই আটকে থাকে, তাহলে তার পক্ষে আজকের দিনের কবিতার যথার্থ মূল্যায়ন সম্ভব নয়। সিনেমাও আর আগের জায়গায় নেই। পঞ্চাশ বছর আগেও যে জায়গায় সিনেমা ডিল করতো এখন আর তা করে না। দর্শক যদি সিনেমার সাথে সাথে বিবর্তিত না হয়, সিনেমারই ক্ষতি। বিশ্বসিনেমায় প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা যতোটা হয়েছে, বিষয়গত উৎকর্ষতা কিন্তু তেমন হয়নি। তার কারণ, বিশ্বজুড়ে দর্শকের বড় একটা অংশ প্রযুক্তিগত চাকচিক্যকেই লুফে নিয়েছে বেশি। ফলে ইউরোপের সিনেমা মার খেয়ে গেছে হলিউডের কাছে। ইন্টেলেকচুয়াল সিনেমার দিন ক্রমশ গত হচ্ছে।
দর্শকের ব্যর্থতার কারণে সিনেমার বিবর্তন অর্থহীন হয়ে পড়ে। আমাদের এফডিসিতে এখনো সেই আশির দশকের সিনেমা তৈরি হওয়ার এটাও একটা কারণ। বাংলাদেশের বড় যে দর্শকশ্রেণি, তারা সিনেমার সাথে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হতে পারেনি, ইন্ডাস্ট্রিও তাই অগ্রসর হয়নি। কেন পারেনি, তার কিছু দিক আমার এ-বইয়ের রঙের দুনিয়া কিংবা বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রির ক্রমপর্যায় প্রবন্ধে পাওয়া যাবে। তবে, মূল কারণ, জ্ঞানভিত্তিক যে সমাজ আমাদের হওয়া প্রয়োজন ছিলো, তা হয়নি। ফলে, আমাদের দেশের একটা বড় শ্রেণিরই শিক্ষাগত, জ্ঞানগত, রুচিগত অনগ্রসরতা রয়ে যাওয়ায় আর্ট-কালচার থেকে শুরু করে সামাজিক-পারিবারিক জীবন, রাষ্ট্রীয় চরিত্র সব পর্যায়ই আজ ক্ষতিগ্রস্ত, ভঙ্গুর।
আপনি বলছেন সিনেমার একটা ভাষা আছে, সে ভাষাটি কেমন?
ভাব প্রকাশের মাধ্যমই ভাষা। তা মুখের ভাষার ক্ষেত্রেও যা, সিনেমার ক্ষেত্রেও তা। এক্ষেত্রে ইমেজ, শটের বুনন, শব্দ, নৈঃশব্দ্য ও পর্দার কুশলী, যেমন অভিনেতা বা প্রকৃতি বা ফ্রেমে যা দেখানো হচ্ছে তা, এই সবকিছু মিলে-মিশে যা তৈরি হয় গল্প এবং গল্পের আমেজ। গল্পভেদে আমেজ ভিন্ন হয়। এ ভিন্নতা আসে টেকনিক, টেকনোলজি, শব্দের ব্যবহার, অভিনয়ের মাত্রার তারতম্যে। এসব মিলিয়েই সিনেমার ভাষা। আর্টের ভাষা সার্বজনীন। দেশ-কালের সীমানারও অতীত। এ-ভাষা সরাসরি মানুষের অনুভূতি, চিন্তার সাথে সম্বন্ধ পাতে। কিন্তু আর্টের ভাষার সমঝদারি সার্বজনীন হয়ে ওঠেনি এখনো।
আপনার নিজের ভাষাশৈলী নিয়েও তো কাজ করেছেন এ বইতে। সেটা কি সিনেমার ভাষার প্রভাব?
সিনেমার ভাষা ঠিক না, বরং সিনেমার আবেশকে ধরার চেষ্টা করেছি বলা যায়। পুনর্বিবেচনা অধ্যায়ে যে তিনটি সিনেমা নিয়ে আলোচনা করেছি, তার ভাষাশৈলীতেও সেই সিনেমাগুলোর আমেজটুকু এনেছি। যেমন, আন্ডারগ্রাউন্ড সিনেমার যে গতিময়তা, হুল্লোড়, ক্যাটাস্ট্রফিক ঘটনার সমাহার, তার রেশ লেখাটায় এনেছি শব্দচয়ন, শব্দ ও বাক্যের বিন্যাসের মাধ্যমে। এর পরের লেখাটা কিন্তু একেবারেই আলাদা। আসা-যাওয়ার মাঝে সিনেমা নিয়ে লেখাটায় সিনেমার কাব্যময়তাকে ছোঁয়ার প্রয়াস আমার ছিলো। ফলে, ইমেজের গল্প কিংবা গল্পের ইমেজ- এই লেখাটা তাই আলোচনার চেয়েও কবিতার মতো করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা ছিলো। তেমনি আবার বাক্সটা খুলে দেখা লেখাটায় সিক্রেট ব্যালট-এর ডকুফিকশনের স্টাইলটাকে রাখার চেষ্টা করেছি।
এছাড়া, এ বইয়ের প্রতিটা লেখার ভাষাশৈলী, ছন্দময়তা, শব্দের ব্যবহার- এসবে ভিন্নতা আছে। প্রতিটার আমেজে ভিন্নতা আছে। অনুবাদগুলোর ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। পাঠককে একই ধরনের লেখার একঘেয়েমিতে ফেলতে চাইনি। বিষয়গত বৈচিত্র্যের পাশাপাশি ভাষাগত, শৈলীগত বৈচিত্র্যও দিতে চেয়েছি।
‘রঙের দুনিয়া কিংবা বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রির ক্রমপর্যায়’ লেখাটি বাংলা সিনেমার উৎপত্তি-সফলতা-ব্যর্থতা-সচলতা-স্থবিরতার এক সুন্দর গাণিতিক গ্রাফচিত্র তবে এতে বাংলাদেশের সিনেমার সঙ্কটই বেশি প্রতীয়মান হয়েছে। কথাটা কতোটা সত্য?
বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি সবসময় সঙ্কটেই ছিলো। সঙ্কটকে আমি চিহ্নিত করছি প্রতিবেশী দেশের নিরিখে। সঙ্কটের কারণ বিবিধ। সেসব নিয়ে আলোচনা করেছি বইয়ে। বলিউডে দেখো, নিজে ইন্ডাস্ট্রি হয়ে ওঠার পাশাপাশি আরো নানান সহযোগী ইন্ডাস্ট্রিও তার কারণে বিকশিত হলো। যেমন সিনেমা নির্মাণ, সিনেমার অভিনয়, নাচ, অ্যাকশনের কৌশল শেখানোর ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে। গানের ইন্ডাস্ট্রি, টিভি ইন্ডাস্ট্রি অনেকাংশে সিনেমানির্ভর। সিনেমার বিপণন, পরিবেশন তো আছেই। বাংলাদেশে কিন্তু তেমন কিছুই সেভাবে গড়ে ওঠেনি। আরো নানান বিষয় এখানে আছে, যা লেখাটায় তুলে আনার চেষ্টা করেছি।
বইটি এতোটাই তথ্যবহুল, ধারণা করা যায় এটি রেফারেন্স হিসেবে নিতে অন্যকে সাহায্য করবে। সেক্ষেত্রে আপনি কতোটা ফ্যাক্ট চেকিং করেছেন?
তাহলে ধরে ধরে বলতে হবে। সিনেমা দেখার চোখ প্রসঙ্গে যে লেখাটা তা একান্তই আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে, যা কিছু শিখেছি-দেখেছি তার প্রতিফলন। বাংলা সিনেমার ইন্ডাস্ট্রির ক্রমপর্যায়ে আমি কিছু তথ্য দিয়েছি যার রেফারেন্সও দিয়েছি। আসলে ফ্যাক্ট চেকিং বলতে এসব ঘটনা তো আমি নিজে পুরোটা দেখিনি, আমার আপাত জীবনের চেয়েও এই ইতিহাসের ব্যাপ্তি বড়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের অভিজ্ঞতা, তাদের দেখা-শোনা এসবের তথ্য সংগ্রহ করেছি। এছাড়া আমার নিজের অভিজ্ঞতা, বিশ্লেষণ ও পড়াশোনা সব মিলিয়েই লেখা। এছাড়া, যদি পরবর্তীতে নতুন সংস্করণ হয়, সে সময়ের নিরিখে তথ্য হালনাগাদ বা অন্যন্য বিষয়ে পরিবর্ধন হবে।