সিদ্দিক আহমেদ মনে পড়ে সর্বদা

শাহরিয়ার পারভেজ | সোমবার , ১ আগস্ট, ২০২২ at ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ

বছর ঘুরে আবার এলো সিদ্দিক ভাইয়ের জন্মদিন। সহজ সরল সাধাসিধে আমাদের সিদ্দিক ভাই।

কিছু মানুষ জীবিত থাকতেই অমর হন। সিদ্দিক ভাই তাদের মধ্যে একজন। জীবদ্দশায় তিনি অনেকের অন্তরের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অন্যরকম ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ যা সহজেই সবাইকে মুগ্ধ করত। ১৯৯৮-৯৯, তখন লেখালেখি না করলেও মাঝে মাঝে ঢুঁ দিতাম আজাদী অফিসে। গুরুগম্ভীর মানুষটাকে দূর থেকেই দেখা হত। সিদ্দিক ভাইয়ের গুণমুগ্ধ পাঠক তখন থেকেই। যতক্ষণ উনার পাশে থাকতাম ততক্ষণ অন্যরকম ভালোবাসা আর ভালোলাগা যেন ছুঁয়ে থাকতো। কিছু কিছু মানুষের কাছে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে বিরক্ত লাগে না। সিদ্দিক ভাই ছিলেন ঠিক সেরকম। মাঝে মাঝে লেখা থামিয়ে গল্প করতেন। আবার লেখা শুরু করতেন।

তিনি দিনের পর দিন লিখে যেতেন। লেখালেখিতে কখনও ক্লান্ত হতে দেখিনি। যখন দেশের বাইরে ছিলাম সপ্তাহে নিয়ম করে ফোনে কথা হতো। দেশে আসার আগে তিনি বইয়ের লিস্ট দিতেন। ব্রিসবেনের বইয়ের দোকানগুলোতে ঘুরে সিদ্দিক ভাইয়ের জন্য বই সংগ্রহ করতাম। আর সেই বইগুলো যখন তাঁর হাতে দিতাম তখন তাঁর খুশিমাখা মুখচ্ছবি… আহা।

তিনি নিয়মিত কলাম লিখতেন, তার কলামগুলোর শিরোনাম ‘দৈর্ঘ্যপ্রস্থ’, ‘নকশী কাঁথার মাঠ’, ‘ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া’, ‘খোলা জানালা’ এবং ‘দক্ষিণের বারান্দা’।
তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৯টি।

কবিতা: জল ও তৃষ্ণা,অনুবাদ কবিতা: আপেলে কামড়ের দাগ, জীবনীমূলক বই: কিছু মানবফুল, চিত্রকলা: পিকাশো, প্রবন্ধ-নিবন্ধ: কবিতার রাজনীতি, খোলা জানালায় গোপন সুন্দরবন, পৃষ্ঠা ও পাতা, গদ্য: ছিটেফোঁটা। তাঁকে নিয়ে ‘সিদ্দিক আহমেদ সম্মাননা স্মারক’ আবির প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়।
সিদ্দিক ভাই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন একুশে পদক, উদীচী, দুর্নিবার, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ও মোহাম্মদ খালেদ ফাউন্ডেশন, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ও বৌদ্ধ একাডেমি, খড়িমাটি থেকে সম্মাননা পান।

এত এত সম্মাননার মাঝে তাঁকে কখনও দেখিনি অহংকারী হতে। যখনই যেতাম তখনই দেখতাম টেবিল জুড়ে বাংলা ইংরেজি পত্রিকা সাথে সাদা পৃষ্ঠা আর কলম। কিছু না কিছু লিখছেন। এমনও সময় ছিল যে সপ্তাহে ছয় দিনেই উনার কাছে যেতাম। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলতেন ‘নো এন্ট্রি’। কখনওবা উনার লেখা শেষ হওয়া অব্দি অপেক্ষা করতাম। আড্ডা কখনও ক্ষণিক আবার কখনও বা বিকেল গড়াতো। দুপুরে তার মধ্যাহ্ন ভোজন ছিল একেবারেই সাধারণ। কখনও ডাল সবজি আবার কখনও বা ডাল আলু ভর্তা। খুব কমই উনাকে আমিষ খেতে দেখেছি। এত বড় মাপের মানুষটির সাধারণ জীবনযাপন আজকের দিনে ভাবাই যায় না। এই শহুরে আকাশে সবাই নিজের মত করে নিজের জীবন সাজিয়ে নিলেও সিদ্দিক ভাই ছিলেন একেবারে ব্যতিক্রম। তিনি ব্যস্ত থাকতেন দৈনিক আজাদীর চাকরি আর বই এবং তাঁর লেখালেখি নিয়ে।

চেরাগী পাহাড়স্থ বর্তমান বাতিঘরের দ্বিতীয় তলাস্থ মাসিক আন্দরকিল্লার পাশে ছোট একটা কক্ষের ফ্লোর থেকে সিলিং অব্দি শুধু বই আর বই। এমনকি বিছানার অর্ধেক অংশ… তাও বইয়ের দখলে। এই কক্ষেই চলত তাঁর সাহিত্য সাধনা এবং দিন যাপন। এমনও দিন গেছে আজাদী অফিসে না পেয়ে জ্বরে কাহিল সিদ্দিক ভাইয়ের দেখা অপরিসর ওই কক্ষে। ছুটির দিন সকালে, কখনওবা বিকেল কিংবা সন্ধ্যা নাগাদ বাতিঘর কিংবা তালেব কখনও ইউনুস মামার দোকানকে কেন্দ্র করে জমে উঠত তুমুল আড্ডা। যার মধ্যমণি ছিলেন সিদ্দিক ভাই। সাথে যোগ দিতেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় অরুণ দাশগুপ্ত, রাশেদ রউফ, প্রদীপ দেওয়ানজি, কামরুল হাসান বাদল ভাই ছাড়াও অনেকে।

সময়ের আবর্তনে একদিন খবর পেলাম সিদ্দিক ভাই অসুস্থ। এক বৃষ্টি ঝরা সন্ধ্যায় দেখা করি ম্যাক্স হাসপাতালে। তখন ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর শরীরে। কথা বলতে প্রচন্ড কষ্ট। আর এই কষ্টের মাঝে অবাক করে দিয়ে বললেন আমি এখনও তরুণ। মানুষের মন কখনও বৃদ্ধ হয় না। চে গুয়েভারাকে নিয়ে যত লেখার উৎসাহ প্রেরণা… সবই তাঁর অবদান। এমনকী চে-কে নিয়ে লেখা তিনটি বইয়ের নামকরণ করেছিলেন সিদ্দিক ভাই। আমি কৃতজ্ঞ। চে আর ফিদেলকে নিয়ে কত অজানা তথ্য উনি দিতেন। একবার একটি বইও উপহার দেন কিউবা বিপ্লবের উপর আর সাথে ছিল তাঁর অটোগ্রাফ। বইপ্রিয় ছিলেন সিদ্দিক ভাই। কতবার যে সময়ে-অসময়ে দেখা হয়েছে জলসা মার্কেটের কারেন্ট বুক সেন্টার কিংবা অমর বইঘরে তার ইয়ত্তা নেই।
আজ সিদ্দিক ভাই নেই।
গতকালএকত্রিশ জুলাই ছিল সিদ্দিক ভাইয়ের জন্মদিন। তিনি নেই এটা মনে হলেই সবকিছু খালি খালি লাগে। ইদানিং চেরাগী পাহাড়ে যাওয়া হয় না। কদাচিৎ গেলে শুধু তাঁর কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে অরুণ সেন, রমা দি, অরুণ দাশগুপ্ত, পুলকদা, সুমন বিশ্বাস, ঋদ্ধি সহ অনেকের কথা। যারা অকালে-অসময়ে চলে গেছেন। যাদের পদচারণাতে মুখর থাকত চেরাগি পাহাড়।

সিদ্দিক ভাইয়ের শূন্যতা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। আজাদী অফিসের দিকে তাকালে তাঁর কথা, তাঁর সাথে কাটানো অনন্য সময়গুলোর কথা মনে পড়ে। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় এই বুঝি সিদ্দিক ভাই আজাদী থেকে নেমে আমাদের সাথে আড্ডায় যোগ দেবেন। জমিয়ে তুলবেন সন্ধ্যা আড্ডা। স্মৃতিকাতরতা কুয়াশাচ্ছন্ন করে দেয় চারপাশ।

চেরাগী পাহাড়ের আলো আঁধারীতে স্বজন হারানোর বেদনায় চোখের জল একান্তে লুকিয়ে হারিয়ে যাই ব্যস্ত জীবনের পথে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধলঞ্চডুবি ও প্লিমসল লাইন
পরবর্তী নিবন্ধচন্দনাইশে এক ব্যক্তির ৩টি গরু চুরি