‘পকেট সাবধান’– এ কথাটা প্রায় সব গণপরিবহনেই লেখা থাকে। তবে এ লেখার তোয়াক্কা না করে পকেটমাররা দিনের আলোতেই যেন তৈরি করে নিয়েছে অদৃশ্য এক অন্ধকার জগৎ। নগরীর বিশেষ বিশেষ এলাকায় চলে তাদের সেই কার্যক্রম। অনেক ক্ষেত্রে গণপরিবহনই যেন হয়ে উঠে তাদের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল। যেসব বাসে অতিরিক্ত ভিড় হয়, সেগুলোকেই পকেটমাররা টার্গেট করে থাকে; আর ভীড়ের সুযোগে নিরীহ যাত্রীদের পকেট থেকে কৌশলে নিয়ে নেয় মোবাইল ফোন ও ম্যানিব্যাগ।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পকেটমারের শিকার হওয়া নিরীহ যাত্রীরা বিপাকে পড়লেও প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া এসব ঘটনায় পকেটমারদের ধরা পড়া ও শাস্তির উদাহরণ খুবই কম। মূলত এ কারণেই পকেটমারদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলছে। সম্প্রতি কয়েকদিনের ব্যবধানে নগরীতে পরপর মোবাইল চুরির মতো ঘটনা ঘটিয়েছে পকেটমার বাহিনী।
কোতোয়ালী থানার ওসি জাহিদুল কবীর এ প্রসঙ্গে বলেন, পকেটমারদের এসব কাজে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইন্ধনদাতার ভূমিকায় থাকে বাসের অসৎ ড্রাইভার ও হেলপার–সুপারভাইজার। আবার কখনো স্থানীয় বড় ভাই টাইপের ব্যক্তিরাও তাদের লালন পালন করে। এ কারণে পকেটমাররা অপরাধ করেও অনেক ক্ষেত্রে সহজেই বাস থেকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সজাগ দৃষ্টি রেখেছে। গ্রেপ্তার করছে। জামিনে এসে তারা আবার একই কাজ করছে। পুলিশের অভিযানের পাশাপাশি গণপরিবহনে চলাচলের সময় যাত্রীদেরও সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে।
নগরীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী সাজ্জাদ হোসেন। মাসিক আয় ৮ হাজার টাকা। এর বেশিরভাগ বাসা ভাড়া আর বাকিটা সংসারের খরচে চলে যায়। হাতে কোনো টাকা নেই। তাই বাধ্য হয়ে গত ১৮ আগস্ট মাটির ব্যাংকে জমানো খুচরা টাকা নোট করতে যান নিউমার্কেট এলাকার পরিচিত এক দোকানে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি পকেটমারের খপ্পরে পড়েন। বিষন্ন মনে বাড়ি ফেরেন। মুখ লুকান স্ত্রী–সন্তানদের কাছে। পরে বাধ্য হয়ে স্ত্রীকে ঘটনাটা জানিয়েছেন। সাজ্জাদের মতো পকেটমারদের দৌরাত্ম্যে প্রতিনিয়ত জমানো টাকা, শখের মোবাইল, গয়না হারাচ্ছেন নগরবাসী। নগরীর বড়পুল, আগ্রাবাদ, চৌমুহনী, দেওয়ানহাট, টাইগারপাস, লালখান বাজার, ২ নম্বর গেট, চকবাজার, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদ, জিইসি মোড়সহ বেশ কিছু এলাকায় নেমেছে এসব চক্রের সদস্যরা।
ভুক্তভোগীদের ভাষ্যমতে, মানুষের মোবাইল ও ব্যাগ হাতিয়ে নিতে তারা সময় নেয় মাত্র ৩০ সেকেন্ড। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একসঙ্গে ৪ থেকে ৬ জন থাকে পকেটমার বা ছিনতাইকারী। কেউ গাড়িতে ওঠানামার সময় চক্রের এক সদস্য প্রবেশ মুখে দাঁড়িয়ে প্রতিবন্ধকতা দেয়, বাকিরা পেছন থেকে হুড়োহুড়ি করে কৃত্রিম ভীড় সৃষ্টি করে। সে সুযোগে পেছন থেকে মোবাইলসহ অন্যান্য জিনিস নিয়ে গেলেও টের পায় না ভুক্তভোগী।
চলন্ত বাসেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। বাসে ভীড় বাড়িয়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে একজন ধাক্কা দেয়, এ সময় আরেকজন এসে পাশে দাঁড়ায়। গ্রুপের আরেক সদস্য এসে পকেট থেকে মোবাইল ও মানিব্যাগ নিয়ে আরেকজনের কাছে হস্তান্তর করে দেয়। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে মাত্র ৩০ সেকেন্ড সময় নেয় তারা।
গত ৫ আগস্ট সাংবাদিক শৈবাল আচার্যের কাছ থেকে তার মোবাইলটি নগরীর দুই নম্বর রুটের সিটি বাসের ভেতর পকেটমাররা নিয়ে নেয়। তার ভাষ্যমতে, মুরাদপুর থেকে তিনি বাসে ওঠেন। কয়েকজনের গ্রুপ একসাথে বাসে উঠে দেওয়ানহাটের পর তার মোবাইলটি বাসের মধ্যেই নিয়ে নেয়। পুলিশি প্রচেষ্টায় পরে তার মোবাইল ফেরত পায় শৈবাল।
একই ধরনের ঘটনা ঘটে তিনদিন আগে সাংবাদিক আলমগীর সবুজের ভাগ্নের সাথে। কলেজ পড়ুয়া ভাগ্নে আব্দুল্লাহ বিকেলে বাসে উঠলে মুরাদপুরের কাছে তার মোবাইলটি একই স্টাইলে নিয়ে নেয়। আব্দুল্লাহর ভাষ্য মতে, একসাথে ৫/৭ জন বাসে ওঠে মোবাইল পকেট থেকে কৌশলে নেয়। সে একজনকে ধরলেও বাকিরা তাকে উল্টো মারতে চায়। বাসের বাকিরা চুপ থাকায় অসহায় আব্দুল্লাহর মোবাইল নিয়ে নেমে যায় পকেটমাররা। আব্দুল্লাহ পাঁচলাইশ থানায় অভিযোগ করেছে।
গত ২৯ মার্চ আগ্রাবাদ এঙেস রোড থেকে আতিক ও তার বন্ধু রাসেলের মোবাইল চুরি হয়। হালিশহরের ৯ নম্বর সড়কের গাড়িতে ওঠার সময় ৬ থেকে ৭ জন মিলে কৃত্রিম ভীড় তৈরি করে পকেট থেকে নিয়ে যায়।
একই কথা বলেন আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা সাকিব তাজ। তার ভাষ্য, গত শুক্রবার আগ্রাবাদ চৌমুহনী মোড়ে এক সঙ্গে চারজন ওঠে ৬ নম্বর বাসে হুড়োহুড়ি করে। এরমধ্যে কৌশলে তার মোবাইলটি টান দিয়ে নেয়ার সময় হাতেনাতে ধরে ফেলেন তিনি। কিন্তু তারা সংখ্যায় বেশি হওয়ায় হুমকি দিয়ে চলে যায়। নগরীর দুই নম্বর গেট এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাদের অধিকাংশই জানিয়েছেন, ছিনতাইকারীরা মূলত কিশোর বয়সী। প্রায় সবার কাছেই ধারালো ছুরি থাকে। কেউ ধরা পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হলেই ছুরি দিয়ে ভয় দেখায়।