বর্তমান বাংলাদেশের পরিবেশ দূষণের অন্যতম অনুষঙ্গ অত্যধিক প্লাস্টিকের ব্যবহার, বিশেষ করে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ও পলিথিনের মাত্রাতিরিক্ত চল। দেশে মাথাপিছু পলিথিনের ব্যবহার দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, ২০০৫ সালে বাংলাদেশে মাথাপিছু পলিথিনের ব্যবহার যেখানে ছিল মাত্র ৩ কেজি, যা ২০২০ সালে এসে দাঁড়ায় ৯ কেজিতে, ঢাকা শহরে এটি ২২ কেজিরও বেশি। ঢাকা শহরে যে বর্জ্য তৈরি হয় তার প্রায় ১০ শতাংশ প্লাস্টিক পণ্য থেকে আসে। বলা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে প্লাস্টিকের ব্যবহার মাথাপিছু ৩৪ কেজিতে পৌঁছাতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালে দেশে নয় লাখ ৭৭ হাজার টন পলিথিনের ব্যবহার করা হয়েছে, যার মাত্র ৩১ শতাংশ পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করা হয়েছে। যদিও সমপ্রতি বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রণীত টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত জাতীয় পরিকল্পনা অনুযায়ী একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার ২০২৬ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। ২০২১ সালের শেষার্ধে প্রকাশিত ওই ডকুমেন্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণের হটস্পট হচ্ছে ঢাকা শহর, ঢাকা শহরের চার পাশের চারটি নদী, চট্টগ্রাম শহর এবং কক্সবাজার। ঢাকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, টঙ্গী খাল ও শীতলক্ষ্যা নদী, এমনকি মেঘনা নদী, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদী, চাকতাই খাল এবং পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকা, কক্সবাজার শহর ও সৈকত এলাকা প্লাস্টিক বর্জ্য হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত।
বাংলাদেশে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে দেশটির তরুণ এবং যুব জনগোষ্ঠী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিক দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী।
বাংলাদেশে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার নিয়ে গবেষণাটি করেছে বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালের মধ্যে ওই গবেষণাটি করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, তরুণ এবং যুবকরাই পরিবেশে প্লাস্টিক দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। যেসব খাবারের সঙ্গে প্লাস্টিকের প্যাকেট রয়েছে, সেগুলোই সবচেয়ে বেশি ভোগ করছে তরুণ এবং যুবকেরা – যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, বাংলাদেশে যত সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার হয়, তার ৩৫ শতাংশ ব্যবহার করে ১৫–২৫ বছর বয়সী জনগোষ্ঠী, আর এ ধরণের প্লাস্টিকের ৩৩ শতাংশ ব্যবহার করে ২৬–৩৫ বছর বয়সীরা।
ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, এই তরুণ ও যুব জনগোষ্ঠী একবার ব্যবহার করা হয় এমন সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক পণ্য বেশি ব্যবহার করে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এক গবেষণায় বলেছে, মুদি দোকান থেকে কেনা পণ্য বহন করার জন্য যেসব ব্যাগ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো প্রকৃতিতে মিশে যেতে ২০ বছর সময় লাগে। চা, কফি, জুস কিংবা কোমল পানীয়ের জন্য যেসব প্লাস্টিকের কাপ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। আর ডায়াপার এবং প্লাস্টিক বোতল ৪৫০ বছর পর্যন্ত পচে না।
হোটেল–রেস্টুরেন্ট থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য আসছে বেশ। ২০১৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, আবর্জনার মধ্যে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের পরিমাণ ছিল মাত্র তিন শতাংশ। অথচ ২০১৯ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২১ শতাংশে।
জরিপে দেখা গেছে রেস্টুরেন্ট, আবাসিক হোটেল, এয়ারলাইন্স এবং সুপারশপ থেকে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক সবচেয়ে বেশি আসছে। এরমধ্যে বেশি আসে রেস্টুরেন্ট থেকে। এরপর রয়েছে এয়ারলাইন্স এবং আবাসিক হোটেল।
আবাসিক হোটেল থেকে যেসব প্লাস্টিক বর্জ্য আসে, সেগুলো হচ্ছে – শ্যাম্পুর বোতল ও মিনি–প্যাক, কন্ডিশনার প্যাকেট, টুথপেস্ট টিউব, প্লাস্টিক টুথব্রাশ, টি ব্যাগ এবং বিভিন্ন খাবারের প্যাকেট। এয়ারলাইন্স থেকে আসে প্লাস্টিকের চামচ, স্ট্র, প্লেট, কাপ, গ্লাস এবং আরো নানা ধরনের প্লাস্টিকের মোড়ক। সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বিপর্যয় বাড়াচ্ছে। প্লাস্টিক পণ্য বিশেষ করে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক আমাদের দেশের প্লাস্টিক হটস্পটগুলোর এমনকি সাধারণ পরিবেশের ড্রেন, নালা, খাল, নদী ইত্যাদির পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেয়, পরিবেশে দূষিত পানি জমে থাকতে বাধ্য করে, মশা–মাছি ও রোগবালাইয়ের বিস্তারে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে। একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিন শুধু পানির প্রবাহই বন্ধ করে না, একই সঙ্গে নদীর তলদেশ ভরাট করে দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের আশপাশের নদীগুলোর তলদেশ পরতে পরতে পলিথিনের স্তূপে ভরে গেছে। অন্যদিকে এর মাধ্যমে আমাদের উর্বর পলিমাটি দীর্ঘদিনের জন্য অনুর্বর হয়ে পড়ছে।
একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ও পলিথিনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, এটি আমাদের আচরণকে দীর্ঘমেয়াদে প্রভাবিত করে এবং এমনভাবে নির্ভরশীলতা তৈরি করে যাতে প্রতিদিনই এর ব্যবহার একটু একটু করে বাড়ছে। অন্যদিকে লাগামহীন প্লাস্টিক ব্যবহার ও এর উৎপাদন প্রক্রিয়া বাতাসে কার্বন ডাই–অঙাইড ও অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর মাইক্রো প্লাস্টিক এখন সবকিছুতে, সমুদ্রের মাছ থেকে শুরু করে মানুষের রক্তে। এটি জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধের জন্য বিশ্বব্যাপী যে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা এই শতাব্দীর মধ্যে এক দশমিক পাঁচ শতাংশের নিচে রাখার লক্ষ্যমাত্রাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।
বাংলাদেশের গৃহীত উদ্যোগ। বাংলাদেশ ২০০২ সালে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে প্লাস্টিকের শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করে। শুধু তাই নয়, সামপ্রতিক সময়ে ২০২০ সালে আমাদের হাইকোর্টে প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা থেকে প্রকৃতি ও দেশকে রক্ষা করার জন্য উপকূলীয় অঞ্চল ও সারা দেশের সব হোটেল ও মোটেলে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেন। পরিবেশ অধিদপ্তর সামপ্রতিক সময়ে ২০৩০ সালের মধ্যে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পূর্ণ রূপে বন্ধের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করেছে। গত ২০২১ সালে সরকার কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন আইন প্রণয়ন করেছেন। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন নীতিমালা আসছে।
যদিও এই আইন ও নির্দেশনা কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে বা বাস্তবায়ন করার কতটুকু সদিচ্ছা ও সক্ষমতা সংশ্লিষ্টদের আছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ইউরোপের দেশগুলোতে গড় মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ১০০ কেজিরও বেশি, যেটি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। তবে বাংলাদেশ প্লাস্টিক দূষণের শিকার হওয়া দেশগুলোর তালিকার সবচেয়ে ওপরে থাকা দেশগুলোর অন্যতম এবং প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনাই এর জন্য দায়ী।
দ্রুত প্রবৃদ্ধি ও নগরায়ণের কারণে বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার এবং দূষণ উভয়ই হঠাৎ বেড়ে গেছে। করোনাভাইরাস মহামারি প্লাস্টিক আবর্জনার অব্যবস্থাপনাকে আরও বাড়িয়েছে।
ক্রমশ বাড়তে থাকা দূষণের হার কমিয়ে সবুজ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতের জন্য প্লাস্টিকের টেকসই ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সবুজ ভোক্তাবাদ বা পরিবেশবান্ধব ভোক্তাবাদ (Green Consumerism) একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ও পলিথিন এর ব্যবহার কমিয়ে একটি যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন ২০১০ অনুসারে পণ্য প্যাকেজিং এর ক্ষেত্রে পাটজাত মোড়ক ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ভোক্তা হিসেবে আমরা যদি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন কাজে পলিথিন বা সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের মোড়কের পরিবর্তে পাট বা কাপড়ের তৈরি পুনরায় ব্যবহার্য ব্যাগ ব্যবহার করি, পলিথিনের ব্যবহার অনেকাংশেই কমে আসবে। নিয়মিত পানির বোতল কেনার পরিবর্তে একটি পুন: ব্যবহার্য পানির বোতল বহন করবার অভ্যাস প্লাস্টিকের ব্যবহার অনেকটুকু কমাতে পারে, আমাদের খরচও বাঁচাতে পারে। একইভাবে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের কাপ, ডিশ, চামচ ও স্ট্রো এর পরিবর্তে ধাতব বা কাঁচের তৈরি তৈজসপত্র ব্যবহারের অভ্যাস বাড়াতে হবে। এই ধরনের পুন: ব্যবহার্য তৈজসপত্র আমরা ভ্রমণের সময় আমাদের সাথে রাখতে পারি, তাতে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার অনেক খানি কমবে।
পরিশেষে বলতে হয় ২০৩০ সালের মধ্যে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করতে গেলে টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনুসরিত আন্তর্জাতিক নীতি অনুসরণের পাশাপাশি পরিবেশ বান্ধব ভোক্তাবাদের চর্চা ও বাড়াতে হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ,
প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম।